মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যুদ্ধের কারণে গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জনপদে অনেক দিন ধরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং এলাকার জনগণ আতঙ্কে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরের সংঘর্ষের কারণে ইতঃপূর্বে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের ভেতরে গোলা এসে পড়ে ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। বর্তমানে এ গোলাগুলির ঘটনা স্থলভাগ থেকে জলসীমার দিকে বিস্তৃত হচ্ছে যা অনাকাঙ্ক্ষিত।
রাখাইন রাজ্যের এ অশান্ত পরিস্থিতি শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এএ বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত বুথিডং শহরের দখল নিয়েছে এবং রাখাইনের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। ১৭ জুন মংডু টাউনশিপের ঘাঁটিগুলো দখলে নিতে সেখানকার বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে এএ।
মিয়ানমারের মানবাধিকারবিষয়ক উপমন্ত্রী অং কিয়াও মো জানান, রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে, মংডু শহরে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা আটকা পড়েছে এবং সংঘাতের কারণে তারা শহর ছেড়ে যেতে পারছে না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে এএকে ঘিরে ধরার চেষ্টা করছে। মংডুর অবস্থান নাফ নদীর কাছে হওয়ায় সেখানে আক্রমণে সহায়তার জন্য নাফ নদীতে যুদ্ধজাহাজগুলো অবস্থান নিয়েছিল। মিয়ানমার নৌবাহিনী নাফ নদীতে এএ’র উপস্থিতি এবং বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য প্রবেশ বন্ধে অবস্থান নিয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। মিয়ানমার নৌবাহিনীর একাধিক যুদ্ধজাহাজ সেন্টমার্টিন দ্বীপের অদূরে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় এবং নাফ নদীর মিয়ানমার সীমানায় অবস্থান-অপারেশন পরিচালনা করছে এবং মিয়ানমারের দিকে এএ’র অবস্থান লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করছে। একই সঙ্গে এএও মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজ ও বোট লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করেছে।
চলমান পরিস্থিতিতে ৫ জুন সেন্টমার্টিন থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রলারে মিয়ানমার থেকে গুলি করা হয়, এতে ট্রলারটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কেউ হতাহত হয়নি। এরপর পণ্যবাহী ট্রলারেও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। পরপর কয়েক দিন এ ধরনের ঘটনার কারণে সেন্টমার্টিনের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ ১০ দিন ধরে বিচ্ছিন্ন থাকায় টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে যাতায়াত, যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সেখান বসবাসরত প্রায় ১০ হাজার মানুষ নিরাপত্তাহীনতাসহ খাদ্য সংকটে পড়ে। মিয়ারমার থেকে গোলাগুলির কারণে জেলেদের সাগরে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যায়। দ্বীপে অনেক দিন ধরে নিয়মিত পণ্য সরবরাহ না থাকায় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যায়। সংকটে থাকা দ্বীপের বাসিন্দাদের জন্য ১৪ জুন কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনে জাহাজে করে মালামাল পৌঁছে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের নৌযানগুলোতে কারা গুলি করেছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি এবং মিয়ানমার সরকার গুলি করার ব্যাপারটি অস্বীকার করেছে। এ ঘটনায় এএ এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনী পরস্পরকে দায়ী করছে। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে চলাচল করা বাংলাদেশের নৌযানগুলোকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু করে এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটে এবং বোঝাই যাচ্ছে, আতঙ্ক ছড়ানোর জন্যই এসব করা হচ্ছে। সেসময় নাফ নদীতে মিয়ানমার নৌবাহিনীর একটি জাহাজ অবস্থান করছিল। ১৫ জুন নাফ নদীর মিয়ানমার অংশ থেকে যুদ্ধজাহাজগুলো গভীর সাগরের দিকে সরে যায় এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনী বাংলাদেশ জলসীমায় টহল শুরু করে। মিয়ানমার থেকে গুলি ছোড়ার পর কয়েক দিন সেন্টমার্টিনে পণ্য সরবরাহে বাধার সৃষ্টি হলেও এখন কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
বাংলাদেশের পর্যটনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর একটি হলো সেন্টমার্টিন। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে নাফ নদীর মোহনায় এ দ্বীপটি অবস্থিত। সেন্টমার্টিন দ্বীপ কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন। এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ এবং এর আয়তন ১৯৭৭ একর। সেন্টমার্টিনে চলাচলের সময় বাংলাদেশের নৌযানে গুলির ঘটনায় মিডিয়া বেশ সরব হয়েছে, চলমান ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এসেছে। ফলে এএ এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনী উভয়েই গুরুত্ব পেয়েছে। বেশি লাভ হয়েছে এএ’র, তারা মিডিয়ার ফোকাসে আসতে পেরেছে। এ ঘটনার পর সেন্টমার্টিনবাসী খাদ্য সমস্যা ও আতঙ্কে ভুগছে, পর্যটক আসা বন্ধ হয়ে গেছে। একশ্রেণির লোক সেন্টমার্টিনের নিরাপত্তা নিয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশের নৌযান লক্ষ্য করে মিয়ানমারের দিক থেকে চালানো গুলির ঘটনায় সেন্টমার্টিনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সমস্যা ও ভয় এখনো পুরোপুরি কাটেনি। বাংলাদেশ মিয়ানমারের দিক থেকে আসা যে কোনো পক্ষের আক্রমণ প্রতিহত এবং এর বিরুদ্ধে পালটা আক্রমণের কথা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সীমান্তে চলা সহিংসতার দিকে নজর রাখছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড এ বিষয়ে সজাগ রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও এ ব্যাপারে প্রস্তুত আছে এবং পরিস্থিতি খারাপ হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।