ডান-বামনির্বিশেষে বিভিন্ন দলের নেতারা বেশ কয়েক বছর ধরেই শেখ হাসিনার সরকারকে কর্তৃত্ববাদী সরকার আখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন। এত বেশিসংখ্যক বার এটি উচ্চারিত হয়েছে যে কে কবে প্রথম এটি বলেছিলেন, সেটি আপাতত মনে পড়ছে না। তবে শুরু থেকেই দু-একজন বামপন্থী রাজনীতিক ছাড়া অন্য নেতারা যখন সরকারকে এ গালিটি দেন, তখন আমার হাসি পায়। এর কারণ একটাই, ওই নেতারা যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, তার কোনোটাই গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয় না।
সবচেয়ে বড় কথা, সরকারবিরোধী সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালেও জনগণের সামনে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি চর্চার এমন কোনো নজির রাখেনি, যাতে করে তারা অন্যকে কর্তৃত্ববাদী বলে সমালোচনা করার নৈতিক অধিকার রাখে। যদিও এর অজুহাতে অন্য পক্ষের অগণতান্ত্রিক আচরণ ন্যায্যতা পায় না।
আভিধানিকভাবে ‘অথরিটারিয়ানিজম’ বা কর্তৃত্ববাদ হলো এমন একধরনের রাজনৈতিক ও সরকারব্যবস্থা, যেখানে কর্তৃপক্ষের প্রতি অন্ধ আনুগত্য থাকে এবং ব্যক্তির চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতাকে দমিয়ে রাখা হয়। কর্তৃত্ববাদী শাসন বলতে এমন সরকারব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো মেকানিজম থাকে না এবং নাগরিক বা রাজনৈতিক অধিকার বলতেও কিছু নেই। সব ক্ষমতাই থাকে এক ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র একটি এলিট গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত। এ ক্ষেত্রে সবার আগে সামরিক সরকারের কথাই মাথায় আসে।
তবে নির্বাচিত সরকারের গায়েও অনেক সময় এ তকমাটি লাগতে দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনকালটিকেও অনেকে কর্তৃত্ববাদী শাসন বলতে ছাড়েননি। ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় আসেন, সে সময় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্টেফান ওয়াল্ট কর্তৃত্ববাদের ১০টি লক্ষণের কথা বলেছিলেন। লক্ষণগুলো মোটামুটি এ রকম—ভীতি অথবা উৎকোচের মাধ্যমে তথ্যব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ; একটি তাঁবেদার তথ্যব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা; প্রশাসন ও নিরাপত্তাব্যবস্থার দলীয়করণ; বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর নজরদারির জন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগানো; অনুগত ব্যবসায়ীদের পুরস্কার, অবাধ্য ব্যবসায়ীদের শাস্তি দান; বিচারব্যবস্থা নিজ মুঠোয় নিয়ে আসা; শুধু এক পক্ষের ওপর আইনের প্রয়োগ; নিজ স্বার্থে ভোটব্যবস্থায় অনিয়ম; ভীতি ছড়ানো এবং বিরোধী রাজনীতিকদের ব্যাপারে অপপ্রচার। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পাশ্চাত্যে ওয়াল্টের এই ‘চেকলিস্ট’ ব্যবহার করে কোন দেশ কতটা কর্তৃত্ববাদী, তা মেপে দেখার একটি প্রবণতা লক্ষণীয়।
কাজেই বর্তমান সরকারকে কর্তৃত্ববাদী বলা হলেও খুব একটা অতিরঞ্জন হয় না। তবে এ দেশের বড় দলগুলো তো বটেই, বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই যেখানে একক নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে পরিচালিত, তাতে তারা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলেও তাদের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক আচরণ আশা করাটা বাতুলতা মাত্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. রওনক জাহান ২০১৫ সালে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর একটি অভিসন্দর্ভ প্রকাশ করেন। এতে প্রধান দুটি দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চার প্রকট অভাব থাকার কথা তুলে ধরা হয়।
দেশে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের বিষয়েও তিনি বেশ কিছু সুপারিশ করেন। গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের মধ্যে আছে—রাজনৈতিক দলগুলোর অগণতান্ত্রিক রীতিনীতি বর্জন করতে হবে; দলগুলোকে গঠনতন্ত্র ও নিবন্ধনের আইনগত শর্ত অবশ্যই প্রতিপালন করতে হবে ইত্যাদি। এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দলগুলোকে গঠনতন্ত্র মেনে চলার পরামর্শ দিলেও বাস্তবে গঠনতন্ত্রেই গলদ রয়ে গেছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ‘দ্য স্টেট অব গভর্ন্যান্স বাংলাদেশ ২০১৩: ডেমোক্রেসি, পার্টি, পলিটিকস’ শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, দেশের বড় দুটি দলে গণতন্ত্রচর্চার ‘একান্ত অভাব’। আওয়ামী লীগে গঠনতন্ত্র রক্ষার জন্য সামান্য আলোচনা হলেও বিএনপির গঠনতন্ত্রেই এসব বিষয় তেমন সুবিন্যস্ত নয়।
অন্যান্য দল নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। তবে বাস্তবে দু-একটি ছোট দলে কিছুটা গণতান্ত্রিক মনোভাব ও চর্চা থাকলেও তা এখনো জনমনে রেখাপাত করার মতো অবস্থায় নেই। দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশেষ দিক হলো, ৪০ বছর ধরে বড় দুই দলের প্রধান একই ব্যক্তি। সব দলেই উত্তরাধিকারের নেতৃত্ব প্রাধান্য পাচ্ছে। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত একই অবস্থা। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক দলের উপযোগী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারেনি।
দেশে রাজনৈতিক দলে কর্তৃত্ববাদের বড় নজির দেখা গেল অতিসম্প্রতি। গত মাসেই বিএনপির ঢাকাসহ চারটি মহানগর কমিটি ভেঙে দেওয়ার পরপর দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে বড় রদবদল আনা হয়েছে দলের কোনো পর্যায়ে কোনো আলোচনা ছাড়াই। দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ যদিও অনেক আগেই শেষ হয়েছে। কিন্তু কাউন্সিল করার কোনো উদ্যোগ তো নেই-ই, এই কমিটির ৩৯টি পদে রদবদলের কথা জানানো হয়েছে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে।
দলের নেতা-কর্মীরা যখন ঈদুল আজহা উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে ৩৯ পদে কাউকে কাউকে নতুন যুক্ত করা হয়েছে, আবার কারও কারও পদ পরিবর্তন করা হয়েছে।