মূল্যস্ফীতির চাপ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পতন, ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্বলতা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে যে অর্থনৈতিক সংকট বিরাজ করছে এর ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ভঙ্গুর হয়ে গেছে। অথচ বহু বছর ধরে আমরা ভালো অবস্থানে ছিলাম। আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও নিম্ন মূল্যস্ফীতি ছিল। বহির্খাত খুব শক্তিশালী ছিল। সেই অবস্থান থেকে আজকের এ ভঙ্গুর অবস্থানে কীভাবে এলাম? এর উত্তরে তিনটি বিষয় বলতে চাই। প্রথমত, সমস্যা কী তা স্বীকার করতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ চুলচেরা বিশ্লেষণ থেকে আসে সমাধান। এরপর সমাধান করতে গেলে নীতির বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে নীতিমালাগুলো দেখেছি, মোটাদাগে সেগুলো তিন ধরনের—নীতির ভ্রান্তি ও দুর্বলতা, নীতি গ্রহণে দ্বিধা এবং এ দুটোর মেলবন্ধনে হয়েছে নীতির অসারতা। অর্থাৎ নীতি অকার্যকর হয়ে গেছে। দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ পতনে দুরবস্থা চলছে। এক্ষেত্রে আমরা কী নীতি গ্রহণ করলাম? সংকটের সময় কোনো উদ্ভাবনী নীতির দরকার পড়ে না, প্রথাগত নীতি আঁকড়ে ধরতে হয়। মূল্যস্ফীতি কমানোর মৌলিক নীতি হলো বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমানো ও সুদের হার বাড়িয়ে দেয়া। সারা বিশ্ব এ নীতি অনুসরণ করেছে। কিন্তু আমরা এ পথে অগ্রসর হইনি। কভিডকালে সুদহারের নয়-ছয় নীতি করেছিলাম। কাদের সঙ্গে আলাপ করে এটি করা হয়েছিল সেটিও আমরা জেনেছি। কিন্তু এর ফলে কি বিনিয়োগ এসেছে, ব্যক্তি খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে? এমন কিছুই ঘটেনি। একদিকে আমরা বাজারভিত্তিক অর্থনীতির কথা বলছি, অন্যদিকে চরম নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনৈতিক নীতিমালা বজায় রেখেছি। যার ফলে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যায়নি। উল্টো ২৪ মাস ধরে এটি বেড়েই চলেছে; ১৫ মাসের বেশি সময় ধরে ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে—১০ শতাংশ ছুঁইছুঁই করছে। অথচ ‘তারা’ বলেছিলেন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি উন্নত দেশের জন্য কার্যকরী সমাধান, আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। আমরা ব্যতিক্রমী বা উদ্ভাবনী কিছু চিন্তা করব। কিন্তু সময়টা আলাদা কিছু চিন্তা করার সময় না। এমন সংকটের সময়ে মৌলিক নীতিই অনুসরণ করতে হয়।
আমাদের কাছের দেশ শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি প্রায় ৭০ শতাংশে পৌঁছেছিল। দেশটির অর্থনীতি খাদে পড়েছিল। আর আমরা সেই খাদের কিনারায় দাঁড়ানো। শ্রীলংকা কীভাবে খাদ থেকে উত্তরণে সফল হলো? এর পেছনে রয়েছে সঠিক সময়ে সঠিক নীতি গ্রহণ ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুবিধা। আমাদের দেশে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিই বলে দিচ্ছে আমরা যথাসময়ে সঠিক নীতি গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছি।
নীতি অকার্যকর হওয়ার আরেকটি উদাহরণ হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পতন। রিজার্ভ ক্রমে নিম্নমুখী। এ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই। আমরা ডলার বিনিময় হারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান ধরে রাখতে চেয়েছি যেন জিডিপিতে মাথাপিছু আয় বেশি দেখানো যায়। আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এটি এক ধরনের ধারণাগত ভুল। যেখানে ভারত, চীন, ভিয়েতনামসহ অন্য দেশ ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মান অবমূল্যায়ন করল, সেখানে আমাদের দেশে দীর্ঘ সময় টাকা শক্তিশালী করে রাখা হয়। এরপর হঠাৎ করেই টাকার মানের অবমূল্যায়ন করা হলে সেই চাপ গিয়ে পড়ে আমদানিতে। রিজার্ভ ক্ষয় বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে এ পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে (বাজারভিত্তিক সুদহার ও ক্রলিং পেগ) সেগুলোও সময়মতো গ্রহণ করা হয়নি। দেরিতে গ্রহণ করা হয়েছে, সেটিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে। অথচ দেশের অর্থনীতিবিদরা এসব সুপারিশ অনেক আগে থেকেই করে আসছেন যা গ্রহণে আমাদের এক ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধকতা দেখা যায়। অবশ্য অনেক সুপারিশ এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার মুদ্রানীতি এককভাবে কাজ করে না। আর্থিক নীতির সঙ্গে এর সামঞ্জস্যতা রক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে আর্থিক কাঠামো সংস্কারের কোনো প্রাক্কলন নেই।
বাজেটে কী আছে, কীভাবে আছে ও কী নেই—এ তিন দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বিচার করি—বাজেটে মধ্যমেয়াদি প্রাক্কলনগুলো গতানুগতিক চিত্র ভেবেই স্থির করা হয়েছে। অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। আইএমএফের কথা শুনে যোগ-বিয়োগ করে নতুন বাজেট করা হয়েছে। বাজেটে দুটি সমস্যাকে অগ্রাধিকার দেয়া যেত—মূল্যস্ফীতি কমানো ও সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেয়া।
প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন বাজেট ও পরিচালন ব্যয় সমন্বয় করা হয়নি। অথচ সংকটের সময়ে কৃচ্ছ্রসাধন দরকার। কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য অনেক পরিচালন ব্যয় কাটছাঁট করা সম্ভব যেটি আমরা কভিডের সময় দেখেছি। পাশাপাশি উন্নয়ন বাজেটও কমানো যেত। বড় বড় মেগা প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে চারটি এ বছর আর ছয়টি ২০২৫ সালে শেষ হওয়ার কথা। প্রতি বছর স্বল্প বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্পগুলোকে চলমান রাখার তো কোনো দরকার নেই। বরং যেগুলো শেষের পথে কেবল সেগুলোর জন্য বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্প দ্রুত সম্পন্ন করা যেত। পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেট সমন্বয়ের অভাবে আসন্ন অর্থবছরেও বাজেট ঘাটতি রাখা হয়েছে জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। গত বছর এটি ছিল জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। তাহলে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা কীভাবে করা হলো? আর মানুষকে স্বস্তি দেয়া যেত সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দের মাধ্যমে। কিন্তু এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ।