জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানেই প্রাণশূন্য হয়ে পড়া বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। আর এ কারণে তিনি স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন তাঁরা সেদিকে খেয়াল রাখেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে কিন্তু আমার আর গুলি-বোমা লাগবে না, এমনিতেই শেষ হয়ে যাব। কাজেই এরাই আমার প্রাণশক্তি। এটুকু মনে রাখতে হবে।’ এসএসএফের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেছেন, ‘একটি বিষয় আমি নিশ্চয়ই বলব, আমরা রাজনীতি করি। আমার আর কোনো শক্তি নেই। শক্তি একমাত্র জনগণ। সেই জনগণের শক্তি নিয়েই আমি চলি।’
প্রধানমন্ত্রীর এসব কথায় কোনো অসত্য নেই। তাঁর জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এটাও ঠিক, নিরাপত্তার নামে যদি শেখ হাসিনাকে জনবিচ্ছিন্ন করা হয়, তাহলে তাঁর যে রাজনীতি, সেটা আর থাকে না। জনগণই শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের শক্তি। জনগণের জন্য, জনগণকে নিয়েই তিনি রাজনীতি করেন। তবে দেশে এখন জনগণের রাজনীতি কতটুকু অবশিষ্ট আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
এখন দেশে প্রধান আলোচনার বিষয় দুর্নীতি। পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ ও রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দুর্নীতির যেসব খবর গণমাধ্যমে সম্প্রতি ছাপা হচ্ছে, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। সরকারি চাকরি মানেই কি তাহলে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পাওয়া? দেশে ঘুষ-দুর্নীতি আছে, এটা নতুন কোনো তথ্য নয়। নতুন হলো, নির্দিষ্ট বেতনের চাকরিজীবীরা কীভাবে এত বিপুল সম্পদের মালিক হলেন, কারা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, আর কতজন এ রকম সম্পদের অধিকারী হয়েছেন, এখন তাদের ভূমিকা কী—এসব প্রশ্ন মুখে মুখে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার একদিকে যেমন দেশের অনেক দৃশ্যমান উন্নতি করেছে, অন্যদিকে বেনজীর-মতিউরের মতো কিছু দুর্বৃত্তেরও যে সৃষ্টি এই সময়কালে হয়েছে, তা-ও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি এসবের লাগাম টেনে ধরবে, না লুটপাটের ধারাই অব্যাহত থাকবে? যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলেও কিন্তু সরকারের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা বাড়বে। সরকার জনপ্রিয়তা হারালে সরকারপ্রধানেরও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। জনবিচ্ছিন্নতা এড়াতে হলে শেখ হাসিনাকেই এগিয়ে আসতে হবে, উদ্যোগ নিতে হবে।
বিরোধী দলের আন্দোলন নয়, সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বেপরোয়া দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে চড়াও না হয়ে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে হবে আন্তরিকতার সঙ্গে। সব দোষ সরকারের বিরুদ্ধপক্ষের ওপর না চাপিয়ে সত্য অনুসন্ধান করতে হবে, জানতে হবে প্রকৃত ঘটনা।
রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি ভুল রাজনৈতিক নীতি-কৌশলের কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, সরকারের ওপর কোনো ধরনের চাপ তৈরি করতে পারছে না। আবার টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে ক্রমাগত আপস করে চলতে গিয়ে আওয়ামী লীগও কিন্তু ঔজ্জ্বল্য হারাচ্ছে। রাজনৈতিক বিরোধীরা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে না পারলেও সরকার ভেতর থেকেই ক্ষয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে বলে মনে হচ্ছে। দেশে আসলে কী হচ্ছে, তা নিয়ে চলছে নানা ধরনের গসিপ।
আমার মতো যাঁরা সরকারের হিতাকাঙ্ক্ষী, তাঁরা এক বিব্রতকর অবস্থায় আছেন বলে আমার মনে হয়। যাঁরা সরকারের সমালোচক, তাঁরা আমাদেরও সমালোচনা করে বলেন, আমাদের নিঃশর্ত সমর্থনের কারণেই নাকি সরকার ভালো হওয়ার চেষ্টা না করে খারাপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। সরকার এটি নিশ্চিত ধরে নিয়েছে যে আমাদের মতো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার মানুষ কোনোভাবেই বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক ধারার পক্ষে যাবে না। সে জন্য সরকারের মধ্যে একধরনের সবকিছু উপেক্ষা করার মনোভাব আছে। কিন্তু যাঁরা সরকার চালাচ্ছেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে, আজকের দিনই শেষ দিন নয়। সামনে আরও দিন আছে।
আমাদের দেশের রাজনীতি নীতিহীনতার পথে চলছে। মানুষ নয়, দল ও দলবাজি এখন প্রধান। এই অবস্থায় কেউ কেউ রাজনীতিতে ‘সমঝোতা’র পথ অনুসরণ করে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু সমঝোতা হবে কার সঙ্গে? সমঝোতার ভিত্তিই-বা কী? যারা ঘুরেফিরে মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার প্রয়াস পায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে বিভিন্নভাবে জাস্টিফাই করে এখনো এবং এর দীর্ঘদিন পরে শেখ হাসিনাকেও যারা হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল, তাদের সঙ্গে সমঝোতা হবে কীভাবে? যারা প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, দেশে যারা প্রতিক্রিয়াশীলতার বিষবাষ্প ছড়াতে চায়, তাদের সঙ্গে সমঝোতা হয় কীভাবে? যারা দেশের সংবিধানে বিশ্বাস করে না এবং অসাংবিধানিক শক্তির উত্থানে সহায়তা করতে চায়, তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে দেশ গড়া যায় কি?