গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবটি ‘সংকোচনমূলক’ বলে বিবেচিত হচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এ বাজেট উপস্থাপন করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অর্থনীতিতে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রধান উদ্দেশ্য ঘোষণা করেছেন।
প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা ও ভারত তাদের মূল্যস্ফীতির হার ইতোমধ্যে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে ফেলেছে। অথচ আমরা পারিনি বর্তমান সরকারের গত মেয়াদের অর্থমন্ত্রীর নিষ্ক্রিয়তা ও কায়েমি স্বার্থের কারণে। সেই তুলনায় মাহমুদ আলী অভিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী। তিনি ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদানের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন দু’বছর। গত সংসদীয় মেয়াদে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন। চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে তাঁর ওয়াকিবহাল থাকার কথা। তাঁর বাজেট বক্তৃতায়ও অর্থনীতির চলমান সমস্যাগুলোর বাস্তবানুগ স্বীকারোক্তি রয়েছে। তবে বাজেট প্রস্তাবকে ‘গতানুগতিক’ বলে যে সমালোচনা রয়েছে, সেটাকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
প্রস্তাবিত বাজেটটি ‘সংকোচনমূলক’। কারণ গত অর্থবছরের ৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার বাজেটের তুলনায় মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় আগামী অর্থবছরের বাজেট ‘ক্ষুদ্রতর’ আকারের। সামষ্টিক অর্থনীতির তত্ত্বে এটাকে ‘কন্ট্রাকশনারি ফিসক্যাল পলিসি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, যেখানে সরকারি ব্যয় কমিয়ে ফেলা হয় সামষ্টিক চাহিদা হ্রাসের জন্য। এদিক থেকে বিবেচনা করলে সরকারি ব্যয় সংকোচন অত্যন্ত সময়োচিত প্রস্তাব।
কথা হচ্ছে, সরাসরি সংঘাত দেখা দেবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকেও বর্তমান ৫ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে আগামী অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশে উন্নীত করার উদ্দেশ্যের সঙ্গে। প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাংক প্রক্ষেপণ করেছে, আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। আমার বিশ্বাস, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকে ৬ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাওয়া বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হবে।
সরকারি ব্যয় এখন দেশের মোট জিডিপির ১৪ দশমিক ৫ শতাংশের মতো, যার মধ্যে সরকারি রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত মাত্র সাড়ে ৮ শতাংশের মতো। বাকি সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ ছিল বাজেট ঘাটতি। এই বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য আমাদের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সূত্র থেকে ঋণ করতে হয়েছে। গত অর্থবছরে বৈদেশিক সূত্রগুলো থেকে আমরা যথেষ্ট পরিমাণ ঋণ পাইনি। তদুপরি সাবেক অর্থমন্ত্রীর নিষ্ক্রিয়তার কারণে রাজস্ব-জিডিপির অনুপাতও ছিল বেশ কয়েক বছর ধরে ক্রমহ্রাসমান। এখন বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাজস্ব-জিডিপির অনুপাতকে কমপক্ষে ১২ শতাংশে উন্নীত করা ‘ফরজ’ হয়ে গেছে।
আগামী অর্থবছরে রাজস্ব-জিডিপির অনুপাতকে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে বাড়ানো এবং বাজেট ঘাটতি-জিডিপির অনুপাতকে ৪ দশমিক ৬ শতাংশে নামানোর যে ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, সেটা সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু চ্যালেঞ্জটি অত্যন্ত কঠিন হবে নিঃসন্দেহে। কারণ এ দেশে যাদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে তারা দুর্নীতির সহায়তায় কর ফাঁকি দিয়ে চলেছে।
এবারের বাজেটে অনেক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বিপরীতে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর আরোপিত কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। ব্যক্তিগত আয়করের সর্বনিম্ন সীমা অপরিবর্তিত রাখা হলেও সর্বোচ্চ আয়করের হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি, আয়করের জাল প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ভালো হতো।
আরেকটি ব্যাপার আমার কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য মনে হয় না– কালো টাকা সাদা করা। যেখানে সর্বোচ্চ আয়কর হার প্রস্তাব করা হয়েছে ৩০ শতাংশ, সেখানে মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকাকে বিনা প্রশ্নে সাদা করার ব্যবস্থার প্রস্তাব করা কতখানি ‘নৈতিক’– সে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
এবারের বাজেটের দুটো চরম সমালোচনামূলক দিক হলো, শিক্ষা খাতের বরাদ্দকে জিডিপির ১ দশমিক ৬৯ শতাংশে নামিয়ে ফেলার প্রস্তাব। জিডিপির শতাংশ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দকেও গত বছরের চাইতে কমিয়ে ফেলা হয়েছে। টাকার অঙ্কে এই দুই খাতের বাজেট বরাদ্দ গত বছরের চাইতে বেশি দেখানো হলেও মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় তা প্রকৃতপক্ষে কম। যোগাযোগ ও পরিবহন খাত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এবং পল্লি উন্নয়ন খাতে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।