বাড়তে শুরু করেছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ঢাকাসহ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে ডেঙ্গু। পার্বত্য বান্দরবানেও হানা দিয়েছে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা। আক্রান্ত ও মৃত্যুহার অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি। মাঠ পর্যায়ে আমাদের গবেষণা দলের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ঢাকার পরে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চাঁদপুর, নরসিংদী, মাদারীপুর, বরিশাল, বরগুনা ও পিরোজপুর জেলায় এডিস মশার ঘনত্ব বেশি। এসব জেলা থেকে প্রায় প্রতিটি জেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকার কারণে খুব দ্রুতই অন্যান্য জেলায় এরা বিস্তৃত হয়ে ডেঙ্গু ছড়াতে থাকবে। যেসব এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব বেশি সেসব এলাকায় আগামী মাসেই বাড়তে শুরু করবে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। এখনই সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে এটি ভয়াবহ হতে পারে।
কয়েক দিন ধরে প্রতিদিন মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের তথ্যমতে, ২৩ জুন পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার ৩৮৫ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছে। বাংলাদেশে মোট ভর্তি রোগীর প্রায় ৬৩ শতাংশ ঢাকার বাইরের। গত বছর এ সময়ে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২৩ শতাংশ। একটা সময়ে ডেঙ্গু শুধু ঢাকার রোগ ছিল, এখন সারা দেশে বিস্তৃত হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে এডিস মশার ঘনত্ব বেশি পাওয়া যাচ্ছে, ডেঙ্গুও ঊর্ধ্বমুখী।
উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য উত্তম জায়গা। উপযুক্ত তাপমাত্রা, আর্দ্রতার সঙ্গে যোগ হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। সব মিলিয়ে ঢাকা যেন মশার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে। বর্ষার শুরুতে ডেঙ্গুর আগ্রাসী ভাব আরো আতঙ্কিত করে তুলেছে নগরবাসীকে।
বাংলাদেশ ১৯৬৪ সালে যখন ডেঙ্গু আসে তখন এটিকে ঢাকা ফিভার হিসেবে অভিহিত করা হয়। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেশি হয় ২০০০ সালে। ওই বছর সরকারি হিসাবমতে, ৫ হাজার ৫০০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ৯৩ জন মারা যায়। বাংলাদেশে ডেঙ্গু সবচেয়ে বড় আঘাত হানে ২০১৯ সালে। তখন প্রায় ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং সারা দেশের ৬৩টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা যথাক্রমে ৬২ হাজার ৩২১ ও ২৮১। বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়াবহ ঢাকার ধারণ করে ২০২৩ সালে। ওই বছর ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যায় এবং ১ হাজার ৭০৫ জন মারা যায়।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশগত কারণ ডেঙ্গু সংক্রমণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জনসংখ্যার ঘনত্ব, মানুষের যাতায়াত, ব্যবহারযোগ্য পানিস্বল্পতা, বিভিন্ন পাত্রে পানি সংরক্ষণ এডিস মশার ঘনত্ব ও ডেঙ্গু বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণ। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের প্যাকেটজাত খাবার ও বোতলজাত পানীয়র জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে প্রচুর বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এসব বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থা করতে না পারার কারণে বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
মাঠ পর্যায়ে গবেষণায় দেখা যায়, গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত ড্রামে, বালতিতে জমানো পানি, বোতলে, ভবনের গাড়ি পার্কিংয়ে জমা পানি, পুরনো ভবনগুলোয় জমা পানি ইত্যাদি জায়গায় এডিস মশার বেশি প্রজনন হচ্ছে। গ্রাম অঞ্চলে কাটা বাঁশের গর্ত, গাছের কোটরসহ বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত পাত্রে জমা পানিতে এডিস মশা পাওয়া যাচ্ছে।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে ডেঙ্গু ঝুঁকি বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা পরিবর্তিত পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ডেঙ্গু ভাইরাসের সম্পর্ক নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা না থাকলেও এটি অনুমান করা যায় যে করোনাভাইরাসের মতো এটিও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে পরিবর্তন করে নিতে সক্ষম।