আমার বন্ধু একটি সরকারি কলেজের অধ্যাপক। কথা প্রসঙ্গে সেদিন বললেন তাদের প্রতিষ্ঠানে সম্প্রতি যে কয়জন এমএলএসএস নিয়োগ পেয়েছেন, তারা সবাই মাস্টার্স পাস। ফলে তাদের চা বানানো বা দোকান থেকে কিছু আনতে বলতে শিক্ষকরা নিজেরাই খুব সংকোচ বোধ করছেন। এছাড়া সারাদিন ফাই-ফরমায়েশ খাটার কাজ থাকেই। ফলে শিক্ষকরা পারতপক্ষে পিয়ন বা এমএলএসএসদের খুব একটা কাজ দিচ্ছেন না। আর এমএলএসএসরা কাজ না পেয়ে অলস সময় কাটাচ্ছেন। ও খুব দুঃখ করে বললো দেখ আমরাও এমএ পাস, ওনারাও এমএ পাস কিন্তু কাজের কত ব্যবধান।
এদিকে খবরে দেখলাম গত ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে দুই ধাপে ২ হাজার ১৭২ ওয়েম্যান নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চতুর্থ শ্রেণির ওয়েম্যান পদের মূল কাজ রেলপথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। এছাড়া রেললাইনের নাট-বল্টু টাইট দেওয়াসহ ছোটখাটো রক্ষণাবেক্ষণের কাজটিও তারাই করেন। কায়িক পরিশ্রমনির্ভর পদটিতে আবেদনের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করেছে এসএসসি বা সমমান। যদিও সর্বশেষ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ধাপ পেরিয়ে যারা ওয়েম্যান হিসেবে চাকরি পেয়েছেন, তাদের সবার শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্স পাস।
শুধু রেলে নয়, যে কোনো চাকরিতেই এখন দেখা যাচ্ছে যে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়, তার চাইতে বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতাধারী প্রার্থীরা আবেদন করেন। দেশে চাকরির ভয়াবহ অভাব। গড় বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ২ শতাংশ হলে কী হবে? যুব বেকারত্বের হার তো ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশে চাকরির যে অভাব রয়েছে, ছোট ছোট পদে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি তারই প্রতিফলন।
খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বেকারত্ব কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এসএসসি পাস শ্রমিকের চাকরি গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন মাস্টার্স পাস ছেলেমেয়েরা। সত্যিই তো বাবা-মায়ের অনেক কষ্টের টাকা খরচ করে, নিজেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে, ৫/৬ বছর সময় পার করে এবং ভবিষ্যতের উজ্জ্বল স্বপ্ন চোখে নিয়ে এই ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছেন, সেকি পিয়ন ও ওয়েম্যান হওয়ার জন্য? নিশ্চয়ই তা নয়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি সেদিকেই পরিচালিত করছে আমাদের তরুণ সমাজকে।
এই পরিস্থিতিরই প্রকাশ দেখতে পেলাম গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সাম্প্রতিক বক্তব্যে। "বাংলাদেশের যুব বেকারত্ব" নিয়ে এক ওয়েবিনারে তিনি বলেন, দেশে বেকার যুবকদের মধ্যে যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশি সময় ব্যয় করেছে, তারাই বেকারত্বের শীর্ষে। এসব শিক্ষিত যুবকরা প্রতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সঙ্গে সমন্বয় করে চাকরি খুঁজতে গিয়ে দীর্ঘসময় বেকারত্বে থাকেন।
"শিক্ষার সাথে বেকারত্বের অদ্ভুত একটা মিল রয়েছে, আর সেই মিল ইতিবাচক দিক থেকে নয়। শিক্ষা বাড়লেই যে তারা চাকরি পাচ্ছে আমরা তা দেখছি না।" তিনি বলেন, যারা প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ১১ বছর কিংবা তারচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন, সেসব শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বেকারত্ব বেশি। নারীদের মধ্যে যারা প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ৯ বছরের বেশি কাটিয়েছেন, তাদের মধ্যেও বেকারত্বের হার উচ্চ।”