আমাদের দেশে সরকার-পক্ষ ও বিরোধী-পক্ষের রাজনীতিকরা বরাবরই পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা দোষারোপ করে প্রতিদিন বক্তব্য দিয়ে থাকেন। প্রায় একই বক্তব্য দিতে তাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা এবং ক্লান্তি কাজ করে না। রাজনীতির খেলায় বা বাস্তব ময়দানে না জিতলেও কোনো পক্ষ কণ্ঠশীলনে জিততে চায়। আগে ভাবতাম নিজ নিজ দলের কর্মীদের চাঙা রাখতে আর সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তারা এসব বলেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা সাধারণ মানুষকে বোকা ভাবেন বলেই নিজেরা চাতুর্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু তারা ভাবেন না, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ থেকে যাত্রা করে ‘স্মার্ট বাংলাদেশের’ দিকে হাঁটা ‘জনগণ’ আর এখন অত বোকা নন। সুতরাং সাতপুরোনো সব ঝগরাটে বক্তব্য বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে কি না তা ভাবা প্রয়োজন। সরকারি ও বিরোধীপক্ষের নেতাদের অতীতে এবং কারও বর্তমানে দুর্নীতির গন্ধ ছড়ালেও উভয়পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে দুর্নীতিগ্রস্ততার অভিযোগ আনছে প্রতিদিন।
আওয়ামী লীগপক্ষ বহুবার বিএনপি শাসনামলকে দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল বলে অভিযোগ করেছে। দুর্নীতিতে তিনবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কুখ্যাতির কথাও বলেছে, এখনো বলছে। এ বক্তব্য তথ্যভিত্তিক। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সূত্রের বরাতে আওয়ামী লীগ নেতারা জোর গলায় অভিযোগ আনতে পারছেন। বিএনপি নেতারাও একই কারণে তেমনভাবে প্রতিবাদ করতে পারছেন না। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপি নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের অনেকেরই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পত্তি প্রকাশ্যে আসায় অভিযোগের সত্যতা মানুষের সামনে প্রকাশিত হয়েছে। তবু একবারের জন্যও বর্তমানের নেতারা দুঃখপ্রকাশ করেননি। তাহলে কোন নৈতিক শক্তিতে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন?
আওয়ামী লীগ সরকার অনেক চমক লাগানো উন্নয়ন করলেও এ সময় সরকারি বা দলীয় প্রশ্রয়ে দুর্নীতিও বেড়েছে। কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির সূচক নিয়ে কোনো সরকারকে চ্যাম্পিয়ন বলে মেডেল দিল কী দিল না, তা বড় কোনো বিষয় নয়। এ দেশের ভুক্তভোগী মানুষ প্রতিদিনই বাড়বাড়ন্ত দুর্নীতির চেহারা দেখছে। আর ছোট দেশ বলে কাছে থেকে দুর্নীতিবাজদের কর্মকাণ্ড সবিস্তারে দেখছে। তাই উভয় পক্ষের দুর্নীতিবিরোধী কথা শুনে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ শুনতে শুনতে মানুষ ক্লান্ত এখন। আগে এসব বক্তব্য শুনে কৌতুকের আনন্দ লাভ করলেও এখন বিরক্তি প্রকাশ করছে।
এক সময় অনেকে বলতেন, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করার প্রয়োজন কী? রাজাকারের তালিকা করাটা সহজ। রাজাকার-আলবদরদের বাইরে এ দেশের সবাই কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযোদ্ধা। একইভাবে এখন বলতে হবে এ দেশের সৎ মানুষের ছোট্ট তালিকা করলেই কাজ ছোট হয়ে যায়, বাকি সব দুর্নীতিবাজ। কেউ প্রত্যক্ষভাবে দুর্নীতি করছে, কেউ পরোক্ষভাবে।
এই যে এখন সাবেক পুলিশ-র্যাব প্রধান বেনজীর আহমদের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হিমালয়সমান সম্পদের কথা গণমাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়ায় সয়লাব হয়ে যাচ্ছে; একে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব? অবশ্য বিচারের আগে এ সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত বলতে চাই না। তবে কতগুলো প্রশ্ন তো সামনে চলেই আসে। আমাদের মতো ছা-পোষা যারা-যারা গোয়েন্দা নই, রাজনীতিক নই তারাও তো অনেকদিন থেকে বেনজীর আহমেদের নানা কীর্তি-কলাপের কথা শুনে আসছি। আদালতের নির্দেশে বেনজীর আহমেদের কয়েক গণ্ডা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হলেও নির্দেশ পালনে বিলম্ব করা হয়েছে, পর্বতসমান সম্পত্তি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্রোক করা হয়েছে, বিদেশে বাড়ি-ফ্ল্যাট থাকার কথা দুদক জানতে পেরেছে। তিনি শতকোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। আবার এত ডামাডোলের ভেতর এমন অভিযুক্ত ব্যক্তি গা ঢাকাও দিয়েছেন।
তাহলে কি বলা যাবে, একটি জাতীয় দৈনিকে বেনজীর উপাখ্যান প্রকাশিত না হলে, ব্যারিস্টার সুমন হইচই না বাধালে এসব আমাদের জানতে আরও দেরি হতো? একদিনে তো তিনি এমন সাগরচুরি করেননি। তাহলে দুদক কেন এতদিন টের পেল না? গোয়েন্দারা কি শীতঘুম দিয়েছিলেন?