অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে একটি যন্ত্র তৈরি হয়, সবকিছুর সমন্বয়ে এ যন্ত্রটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় কাজ করে। এখানে এ যন্ত্রটিকে মনিটরিং করার জন্য বিভিন্ন ধাপে টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিফ ইঞ্জিনিয়ার পর্যন্ত কাজ করে।
অনেকে রাষ্ট্রকেও একটি যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করে, যদিও এখানে যন্ত্রের মতো কোনো মেকানিক্যাল যন্ত্রাংশ নেই। রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান অঙ্গ, সবার জানা। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রধান উপাদান প্রশাসনযন্ত্র। এই প্রশাসনযন্ত্রের সাহায্যে রাষ্ট্র তার বিভিন্ন কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকে। এই প্রশাসনযন্ত্রের অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা আছে। রাষ্ট্রকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য, বিভিন্ন ধাপে, বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে রাষ্ট্রকে পরিচালনা করার জন্য, এই প্রশাসনযন্ত্র নিচ থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে ও আইন প্রয়োগ করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে সচল রাখে।
এই প্রশাসনের কয়েকটি দিকের মধ্যে আছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিশেষ সংস্থাও আছে। এই সব সংস্থা দিয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় রাষ্ট্রকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য। রাষ্ট্রের মধ্যে যেন দুর্বৃত্ত গড়ে উঠতে না পারে, রাষ্ট্রকে সচল রাখার জন্য, কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোনো দল যেন চক্রান্ত করে রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য সর্বদা সজাগ থাকে ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে।
ওপরের কথাগুলো বললাম এই কারণে, সম্প্রতি আমাদের এই রাষ্ট্রযন্ত্রে তিনটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেল। ঘটনাগুলো রাষ্ট্রের কাছে খুব একটা সুখকর নয়। এই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাষ্ট্রযন্ত্রে যাদের যে দায়িত্ব ছিল, সেগুলো ঠিকমতো পালিত হয়নি।
সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। একটা কথা বলে রাখি, আমেরিকার এই নিষেধাজ্ঞাকে অনেকেই রাজনৈতিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলবেন, আসলেই এটা সত্য। আমেরিকা অনেক সময় তার স্বার্থ হাসিলের জন্য অনেক কিছু করে, এখানেও সবাই মনে করছে আমেরিকা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ কাজটি করেছে, আমরা অনেকেই এর সঙ্গে একমত। কথা হলো, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আগে তোলা হয়েছিল, তাঁর ভাইয়েরা ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে ছিলেন, তাঁদের সাজার মাত্রা ছিল মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত। এ খবরগুলো রাষ্ট্রযন্ত্রের জানা উচিত ছিল।
রাষ্ট্রের হাতে ছিল এনএসআই, এসবি, ডিজিএফআইয়ের মতো গোয়েন্দা সংস্থা। সেনাপ্রধান হওয়ার আগেই তাঁর সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপস্থাপন করা উচিত ছিল। আজিজ যত নিষ্কলঙ্ক, নিষ্পাপ মানুষ হোন না কেন, তিনি আমাদের সমাজের রক্তমাংসের একজন মানুষ।
আজিজ কি জানতেন বা জানতেন না, এটা মানুষ বিশ্বাস করে না, আজিজের ভাইয়েরা অপ্রত্যাশিতভাবে রাষ্ট্রের আনুকূল্য পেয়েই মুক্তি পেয়েছেন এবং বিদেশে কেটে পড়েছেন। শুধু কেটে পড়েননি, এরপরও তাঁদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সংস্থা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তথ্য দিতে হয় ভুল করেছে, অথবা জেনেশুনেই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়কে বিভ্রান্ত করেছে। এ কাজটি না হওয়াই ভালো ছিল, এটা বেশির ভাগ মানুষই বোঝেন এবং বলবেন। সেনাবাহিনীর প্রধান হতে হলে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়।
তারপর আসি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রতীক ও প্রধান ব্যক্তি পুলিশের আইজিপি প্রসঙ্গে। পুলিশের আইজি হওয়ার আগে ডিআইজি এবং অ্যাডিশনাল আইজিপি হতে হয়েছে। প্রতিটি পদে পদোন্নতি পেতে হলে চাকরিজীবনের শ্রেষ্ঠত্ব ছাড়াও, বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তাঁদের চরিত্র ও কাজকর্ম বিশ্লেষণ করা হয়। এ ব্যাপারেও এসবি, এনএসআই, ডিজিএফআইসহ অন্যান্য সংস্থা তথ্য-উপাত্ত ও তথ্য বিশ্লেষণমূলক রিপোর্ট দিয়ে সরকারকে সাহায্য করেছে, অবশ্যই এই সব রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই বেনজীর আহমেদকে আইজিপি পদে পদস্থ করেছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা।
বেনজীর আহমেদ এক দিনে তাঁর এত সম্পত্তি অর্জন করতে পারেননি। অন্তত ১০ বছরে তিনি এই সম্পদ অর্জন করেছেন। এক বাক্যে সবাই স্বীকার করবেন, এত সম্পদ সৎপথে উপার্জন করেননি। এখন সুধীসমাজ এ প্রশ্ন করতেই পারে, তাঁর বিভিন্ন পদোন্নতির সময় উল্লিখিত সংস্থাগুলো এসব তথ্য-উপাত্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে কেন উপস্থাপন করেনি। এখানে অবশ্যই তাদের ব্যর্থতা ও গাফিলতি আছে। আর ব্যর্থতা ও গাফিলতি না থাকলে, ইচ্ছাকৃতভাবে এ রকম একজন দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিকে এই পদে উন্নীত করার জন্য তারা সাহায্য করেছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে।