কলকাতার নিউটাউনের অভিজাত আবাসিক এলাকা সঞ্জীবা গার্ডেনসের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ-সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের হত্যাকাণ্ড দেশের মানুষকে অনেক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। হত্যার পর লাশ কয়েক টুকরো করে ট্রলি ব্যাগে ভরে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। যিনি খুন হয়েছেন, তিনি পরপর তিনবার ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নে দেশের আইনপ্রণেতা হয়েছেন। পাশাপাশি তিনি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। অথচ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত তিনি ইন্টারপোলের লাল তালিকাভুক্ত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে খুন, মাদক এবং সোনা চোরাচালান, হুন্ডি ব্যবসার অভিযোগে ২২টি মামলা ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইন্টারপোলের তালিকা থেকে তার নাম প্রত্যাহার করা হয়। একই সঙ্গে সব মামলা থেকে অব্যাহতি পান তিনি। এরপর ২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। বলা বাহুল্য, এ তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার অর্থই ছিল সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়া।
একাধিক গোয়েন্দা সূত্র গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে, আনোয়ারুল আজিম হত্যাকাণ্ডের পেছনে হুন্ডি, মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানের মতো বিষয় জড়িত থাকতে পারে। এসব কারবারে বহু বছর একক আধিপত্য বিস্তার করে আসছেন আজিম। এ খুনের মূল পরিকল্পনাকারী হিসাবে আমেরিকার পাসপোর্টধারী আক্তারুজ্জামান শাহীন নামে যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তিনি এমপি আনারের বন্ধু এবং ব্যবসায়িক অংশীদার। কলকাতায় শাহীন ও আজিমের যৌথ ব্যবসা রয়েছে। কলকাতা পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এমপি আনোয়ারুল আজিমকে নির্মমভাবে হত্যার নেপথ্যে স্বর্ণ চোরাচালানের অর্থ ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। আক্তারুজ্জামান শাহীন এবং এমপি আনোয়ারুল আজিম উভয়েই স্বর্ণ এবং মাদক চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, স্বর্ণ চোরাচালানের বিপুল অর্থ ভাগাভাগি নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সেলেস্তি রহমান নামে একজন নারীর যোগসূত্র পাওয়া গেছে, যাকে হানি ট্র্যাপ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ৫ কোটি টাকায় খুনের কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয় আমানউল্লাহ আমান নামে একজন কন্ট্রাক্ট কিলারকে, যিনি একসময় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন ১০ মে অর্থাৎ এমপি আনারের ভারতে প্রবেশের ঠিক আগের দিন কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। পরবর্তীকালে নেপাল, দুবাই হয়ে আমেরিকায় চলে যান। সেলেস্তি রহমান শাহীনের বান্ধবী হলেও এবার তিনি এমপি আনারের সঙ্গী হন। ১৫ মে তিনি মূল হত্যাকারী আমানের সঙ্গে বিমানে ঢাকায় ফিরে আসেন। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সূত্রে পুরো ঘটনা সম্পর্কে এমনটাই জানা যাচ্ছে।
একজন নারীকে হানি ট্র্যাপ হিসাবে ব্যবহার করে একজন সংসদ-সদস্যকে বিদেশের মাটিতে একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া গেল। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী খুনের শিকার এমপি আনারের দীর্ঘদিনের বন্ধু। সুতরাং তিনি জানতেন, একজন নারীকে দিয়ে সহজেই তার বন্ধুকে হত্যার জন্য নির্ধারিত স্থানে নিয়ে আসা যাবে। এ থেকে দেশের একজন আইনপ্রণেতার নৈতিক দৃঢ়তা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
ডিবিপ্রধান সংবাদ সম্মেলন করে পুরো হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু কেন এমপি আনার সেই ফ্ল্যাটে গেলেন এবং সেলেস্তি রহমানের ভূমিকা কী ছিল, সেই অংশটা এড়িয়ে গেলেন। সম্ভবত সচেতনভাবেই। তার ভাষ্যমতে, ডিবির অপরাধ তদন্তে সক্রিয়তা এবং সক্ষমতায় ভীত হয়ে হত্যাকারীরা খুনের জন্য কলকাতাকে বেছে নেয়। অর্থাৎ আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পেশাদারি এবং সক্ষমতার দিক থেকে অনেক উঁচু পর্যায়ের। কেন যে তারা সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের তদন্তের বেলায় চুপসে যায়, ডিবিপ্রধান হারুনের সক্ষমতার বয়ানের সঙ্গে সেটা মেলাতে পারলাম না। হয়তো এটি আমাদের মতো সাধারণের মাথায় ঢুকবে না। এর মধ্যেও হয়তো কোনো বিশেষ মাজেজা আছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন কেন দিতে পারে না, সেটি ভাবার বিষয়। এক্ষেত্রেও কি বিশেষ মাজেজা আছে?
হত্যার কারণ সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি হননি ডিবিপ্রধান। এমনকি তিনি বলেছেন, হত্যার কারণ অনুসন্ধানের চেয়ে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করা বেশি জরুরি। নিঃসন্দেহে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। কিন্তু আমাদের পেশাদার এবং তদন্তে অতি উচ্চসক্ষমতাসম্পন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অজানা থাকার কথা না, হত্যাকারীদের চিহ্নিত করার জন্য হত্যার মোটিভ জানা দরকার। সেক্ষেত্রে অপরাধীদের চিহ্নিত করে খুঁজে বের করা সহজ হয়। তবে কি সরকার এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের কারণ প্রকাশ্যে আনতে চাইছে না?
ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আনার কী ছিলেন বড় কথা নয়, জনপ্রিয়তা দেখে দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ চোর, ডাকাত, খুনি, চোরাকারবারি, মাফিয়া-যে কেউই জনপ্রিয়তা থাকলে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে পারেন! তবে একই সময়ে জনাব কাদের বলেছেন-‘এসব যখনই প্রমাণিত হয়, প্রধানমন্ত্রী তার জিরো টলারেন্স নীতি থেকে অন্যায়কারী, অপরাধী দলের লোক হলেও ছাড় দেন না’। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আনারের ইন্টারপোলের রেডলিস্টে থাকার বিষয়টি সরকারি দলের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের অজানা ছিল। এমনকি ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে আনোয়ারুল আজিম আনার যে ২২টি মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ছিলেন, সেই ব্যাপারেও তাদের নিশ্চয়ই কোনো ধারণা ছিল না। অন্তত আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার তো অবশ্যই কোনো ধারণা ছিল না। নতুবা অপরাধ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলা প্রধানমন্ত্রীর তো নিশ্চয়ই আনারকে টানা তিনবার দলের মনোনয়ন দেওয়ার কথা না। নাকি সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি কেবল বিরোধী দলের আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?