কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিতি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে, কিন্তু নজরুল উঁচুমার্গের ‘সাম্যবাদী কবি’ও বটেন। নজরুলের সাম্যচিন্তা তাঁর জীবনের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত। তাঁর শৈশব-কৈশোরের জীবন অভিজ্ঞতা, তাঁর যৌবনের যাপিত জীবন তাঁকে বাস্তব পৃথিবীর দারিদ্র্য, অসমতা ও অসাম্যের সঙ্গে পরিচিত করেছে অত্যন্ত নগ্নভাবে। তাই নজরুলের কবিতায়, গানে ও প্রবন্ধে তাঁর সাম্যবাদী চিন্তা-চেতনা অত্যন্ত জোরালোভাবে পরিস্ফুট। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, সমতার পক্ষে, সাম্যের পক্ষে রবীন্দ্রনাথও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। কিন্তু তাঁর সাম্যচিন্তা, তাঁর মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা এবং সেই সঙ্গে নৈতিকতার বোধ থেকে এসেছে, যাপিত জীবনের বাস্তবতা থেকে নয়। অন্যদিকে নজরুলের সাম্যচিন্তা একেবারেই জীবন থেকে নেওয়া।
নিজের বিভিন্ন লেখায় নজরুল কখনো সাম্যের কথা বলেছেন, কখনো সমতার কথা বলেছেন। এ বিভাজন একটি সচেতন চিন্তা থেকেই এসেছে। সাম্যের ধারণাটি আপেক্ষিক, যেখানে সমতার ধারণাটি অনপেক্ষ। নজরুল যখন বিশ্বমানবতার কথা বলেন, তখন একটি অনপেক্ষ মাত্রিকতা থেকেই সে কথা বলেন। অন্যদিকে তিনি যখন নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলেন, তখন সেটা একটা আপেক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি, নজরুলের সাম্যচিন্তার দুটো স্তর আছে—একটি সামষ্টিক, অন্যটি ব্যষ্টিক।
সামষ্টিক পর্যায়ে নজরুল সাম্যচিন্তার উচ্চতম মাত্রিকতায় অবস্থান করেছেন। সেই সাম্যচিন্তায় বিশ্বমানবতা, সামগ্রিক মানবতাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর কাছে প্রতিটি মনুষ্যজীবনই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন:
‘গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান।’
মানুষকে সমভালোবাসায়, সমশ্রদ্ধা ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই এই সাম্যচিন্তার মূলকথা।
এই শ্রদ্ধা, এই মর্যাদা নজরুল একজন দরিদ্র মানুষকেও দেন। তাই দারিদ্র্যের অহংকারকে তিনি একটি উচ্চতম স্তরে প্রতিস্থাপন করেছেন তাঁর ‘দারিদ্র্য’ কবিতায়। অতিজোরালোভাবে তিনি বলেছেন:
‘হে দারিদ্র্য,
তুমি মোরে করেছো মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান।
কণ্টক মুকুট শোভা। দিয়াছ তাপস, অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস।’
দারিদ্র্যের মাঝেও যে মর্যাদা ও অহংকার থাকে, তাকেই সমমর্যাদায় নজরুল প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিত্তের সঙ্গে। এই সমতা বোধ তুলনাহীন। বিশ্বমানবতার প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘আমার জবানবন্দীতে’ও।
ব্যষ্টিক দিক থেকে নজরুল সাম্যকে দেখেছেন চারটি মাত্রিকতায়—বিত্তবান ও দরিদ্রের মধ্যে, শ্রম ও পুঁজির মধ্যে, ধর্মীয় গোষ্ঠীদের মধ্যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে। ধনী-নির্ধনের মধ্যে অসমতাকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন এই বলে:
‘তুমি শুয়ে রবে তেতলার পরে,
আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব,
সে ধারণা আজ মিছে’।
দরিদ্র মানুষদের শোষণের মাধ্যমে যে ধনীর বিত্ত গড়ে ওঠে, সেটা নজরুল পরিষ্কার করে বলেছেন:
‘তোমার অট্টালিকা কার খুনে রাঙা?
ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইঁটে আছে লিখা।
তুমি জান না ক’,
কিন্তু পথের প্রতি ধূলিকণা জানে, ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!’
কিংবা:
‘দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
তবে মানবতায় চিরবিশ্বাসী নজরুল আশা ছাড়েননি। তাঁর আশাবাদী মন ব্যক্ত করেছে যে এ অসাম্য একদিন শেষ হবে। তিনি যেন দেখতে পেয়েছেন সেই দিনকে, যেখানে দরিদ্রকে তার পাওনা কড়ায়-গন্ডায় বুঝিয়ে দিতে হবে:
‘আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা,
শুধিতে হইবে ঋণ!’