অনেক রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের সাক্ষী এই ঢাকা নগরী। কিন্তু সেসব আন্দোলন-সংগ্রামকে স্মরণীয় করে রাখতে উদ্যানের নামকরণের মতো উদ্ভাবনী উদ্যোগ খুব বেশি নেই। ফার্মগেট এলাকার উদ্যানটি ছিল সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে প্রথম শহীদ আনোয়ারা বেগমের নামে উদ্যানটির নামকরণ করা হয়েছিল। এই নারী নাখালপাড়ায় নিজ ঘরের বারান্দায় শিশুসন্তান নার্গিসকে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর সময় পুলিশের গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। ব্যতিক্রম এদিক থেকেও যে, একজন নারীর নামে উদ্যান ঢাকা শহরে খুব বেশি পাওয়া যাবে না। তাও আবার মধ্যবিত্ত পরিবারের নারী।
‘শহীদ আনোয়ারা উদ্যান’ এখন মেগা ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেটের একমাত্র সবুজ গালিচা। এলাকাবাসীর মতে, উদ্যানটিতে প্রায় ২০০ বড় গাছ ছিল, যেখানে নানা রকম পাখির আবাস ছিল। আমি নিজেও আশির দশকে ওই উদ্যান ছায়াঘেরা দেখেছি। ব্যস্ত এলাকা ফার্মগেটের অধিবাসী ছাড়াও আশপাশে যাতায়াতকারী নানা শ্রেণির মানুষ সেই আনোয়ারা উদ্যানে বিশ্রাম নিতেন, যোগ ব্যায়াম ও হাঁটাহাঁটি করতেন। রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাতেও (ড্যাপ) আনোয়ারা উদ্যানকে উন্মুক্ত স্থান হিসেবে দেখানো হয়েছে।
ক্রমেই ইট-কাঠে ঢাকা পড়া এই ঢাকা নগরীতে যখন সামান্য কয়েকটি উদ্যান বাঁচিয়ে রাখা সবচেয়ে জরুরি ছিল, তখনই ২০১৮ সালে মেট্রোরেল নির্মাণকাজ শুরুর পর সেই উদ্যানের প্রয়োজন পড়ে ঢাকা মাস ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেডের। যুক্তি– মেট্রোরেলের অস্থায়ী কার্যালয় আর নির্মাণসামগ্রী রাখা। আবেদন করলে গণপূর্ত অধিদপ্তর উদ্যানটি নির্মাণসামগ্রী রাখতে অনুমতি দেয়। সেই থেকে পার্কটি কোম্পানির দখলে।
২০২৩ সালে এসে কোম্পানি সিদ্ধান্ত নিল, উদ্যানটিতে মেট্রোরেলের কার্যালয় আর বিদেশের মতো করে ‘স্টেশন প্লাজা’ বানানো হবে। সে অনুযায়ী ২০২৩ থেকে শুরু হলো অনুমতি চেয়ে গণপূর্তকে চিঠি লেখা। ২০২৩ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত অনুমতি পাওয়া না গেলেও ৩০ জানুয়ারি কোম্পানির সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, গণপূর্ত অধিদপ্তর উদ্যানে কার্যালয় ও স্টেশন প্লাজা নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে!
উদ্যানটি গণপূর্ত অধিদপ্তর হস্তান্তর করল কোম্পানির হাতে। এ সিদ্ধান্ত জাতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে এবং মেট্রোরেলের নির্মাণ শেষ হওয়ার পরেও উদ্যান উন্মুক্ত না করার কারণে জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হলো। ঢাকা উত্তরের মেয়র স্বয়ং মেট্রোরেল কোম্পানির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেন। জনগণের ব্যবহার্য উদ্যানে স্টেশন প্লাজা নির্মাণের এমন জনবিরোধী ও আইনের পরিপন্থি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি লিখিত কোনো আপত্তি দিয়েছেন কিনা, আমাদের জানা নেই।
এবার শহীদ আনোয়ারা উদ্যান থেকে আলোকপাত করি মেগা ঢাকার উন্মুক্ত স্থানের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের দাবি, এ শহরে প্রয়োজনের তুলনায় উন্মুক্ত স্থান রয়েছে মাত্র অর্ধেক– ৭ শতাংশ। গাছ শুধু পৃথিবীর সবচাইতে দূষিত বায়ুর এই নগরে অক্সিজেনই দেয় না; তাপদাহের ঝুঁকিতে থাকা তাপমাত্রার অতিষ্ঠকর যন্ত্রণা থেকেও নগরবাসীকে বাঁচায়। পৃথিবীর সবচাইতে জনবহুল নগরীর মানুষকে বাঁচাতে প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক উন্মুক্ত স্থান থাকলেও এ মহানগরীতে বাণিজ্যিক স্থাপনা, মার্কেট আর দোকানের অভাব নেই। সেই পরিস্থিতিতে আরও একটি গণউদ্যানকে দাপ্তরিক বা বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি গণপূর্ত অধিদপ্তর কী যুক্তিতে দিতে পারে, আমার বোধগম্য নয়।