ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির প্রাণহানির ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে দুর্ঘটনা মনে হচ্ছে। অন্তত ইরানের সূত্রে কিংবা সংবাদমাধ্যমের তরফে আমরা যেসব খবর পাচ্ছি, তাতে এখন পর্যন্ত একে দুর্ঘটনাই বলা যায়। যদিও নাশকতা, হত্যাকাণ্ড কিংবা এর সঙ্গে ষড়যন্ত্রের গুঞ্জনও উঠছে। কিন্তু কোনো কিছুই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এখনও পুরো বিষয়টি স্পষ্ট নয়। ইরান নিশ্চয়ই পুরো ঘটনার তদন্ত করবে।
তবে এই অঘটন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। হেলিকপ্টারের কথাই বলি। ইব্রাহিম রাইসিকে যে হেলিকপ্টার বহন করছিল, এর মডেল হলো বেল ২১২। এই মডেল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এবং ১৯৭৯ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রের এটি ইরানের কাছে বিক্রি করার কথা নয়। সে হিসেবে উড়োযানটি অন্তত ৪৫ বছরের পুরোনো। সেখানকার বৈরী ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয় ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। সেখানে ঘন কুয়াশা ও বৃষ্টি ছিল। গভীর উপত্যকায় বাতাস ও কুয়াশা বিপজ্জনক। এমন পরিস্থিতির মধ্যে তিনি সেখানে কেন গেলেন– সেটাও প্রশ্ন। কারণ আমরা জানি, এখন আবহাওয়ার অনেক কিছুরই পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়। অন্তত কয়েক দিন আগেই বলে দেওয়া যায়, ওই এলাকার আবহাওয়া কেমন যাবে। সে জন্য আমার কাছে পুরো বিষয়টি অদ্ভুত লাগছে।
ইব্রাহিম রাইসিকে বহন করা হেলিকপ্টারে তিনি ছাড়াও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ কয়েকজন শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। সংবাদমাধ্যমে আট-নয়জনের কথা এসেছে, যারা সবাই মারা গেছেন। এতজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি একসঙ্গে হেলিকপ্টারের চড়ার বিষয়ও বিস্ময়কর। তার চেয়ে বড় বিষয়, এই দুর্ঘটনা এমন সময়ে ঘটেছে, যখন মধ্যপ্রাচ্য উত্তাল। ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনাও ঘটল, বেশিদিন হয়নি। এমন গোলযোগপূর্ণ সময়ে নিরাপত্তায় এমন গাফিলতি বিস্ময়কর। যদিও রাইসির হেলিকপ্টারের সঙ্গে তাঁর বহরের অন্য দুটি হেলিকপ্টার ছিল, সেগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেগুলোই বা কীভাবে নিরাপদে ফিরে এলো– এমন প্রশ্নও সংগত।
দুর্ঘটনার বাইরে অন্য যেসব শঙ্কার কথা উঠছে, সে বিষয়ে কিন্তু ইরানও আপাতত কিছু বলছে না। আমি মনে করি, এ বিষয়ে সত্যিকার অর্থেই তদন্ত হওয়া দরকার। এটা কি নিছক দুর্ঘটনা? যেমনটা দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলা হয়, বৈরী আবহাওয়ার কারণে হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। নাকি এ দুর্ঘটনার পেছনে অন্যকিছু আছে? স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু ইরানের মতো একটি দেশ, যারা নিরাপত্তার ব্যাপারে এতটা সচেতন; যাদের এত গোয়েন্দা বাহিনী; সেখানে ইরানের প্রেসিডেন্টের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তির এমন পরিস্থিতিতে প্রাণ হারানোকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখা কঠিন।
সময়টার কথা আমি বারবার বলছি। এখন অনেকটা যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ সময় তো নিরাপত্তা-সংক্রান্ত সব বিষয়ে আরও ভালোভাবে খেয়াল রাখার কথা। এটা ইরানের প্রেসিডেন্টের জন্য তো বটেই, তাঁর সঙ্গে থাকা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্যান্য ব্যক্তি; রাষ্ট্রের দিক থেকে এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যাপার থেকেই প্রশ্নটা উঠছে। সত্য উদ্ঘাটনের জন্য হয়তো আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।
বিশেষ করে ইরানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অনেক দিন ধরেই তিক্ত। ১৯৮০ সাল থেকে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। দেশটিতে উল্টো যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা চলছে। ইরানের সঙ্গে আঞ্চলিক দ্বন্দ্বও চলছিল। আরও বড় সংকট তৈরি হয়েছে গাজায় হামলার কারণে। ফিলিস্তিন বিষয়ে ইরান শুরু থেকেই সরব। ইরান হামাসকে যেভাবে জোরালো সমর্থন দিয়েছে, অন্যরা সেভাবে এগিয়ে আসেনি। সে কারণেই ইরানের সঙ্গে প্রকাশ্যে যুদ্ধে নেমে পড়ে ইসরায়েল। যদিও সেটা বড় যুদ্ধ বাধায়নি। কিন্তু একটা উত্তেজনা তো বিরাজ করছিল। সে জন্যই এ পরিস্থিতিটা কঠিন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা দাবি করছিল।
ইরানে আমরা ইব্রাহিম রাইসির শক্তিশালী নেতৃত্ব দেখছিলাম। সামরিক সক্ষমতায় শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে র্যাঙ্কিংয়ে ইরানের অবস্থান ১৪তম। দেশটি ধীরে ধীরে পারমাণবিক সক্ষমতায় নজর দিচ্ছিল। এ বছরের শুরুতে ইস্পাহানে নতুন একটি পারমাণবিক গবেষণা চুল্লির নির্মাণকাজ শুরুর ঘোষণা দেয় ইরান। এর কয়েক দিন আগেই দক্ষিণাঞ্চলে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে বলে জানিয়েছিল দেশটি। তারা তুরস্কের সঙ্গে কথাও বলছিল। যদিও তাদের কিছু বিষয়ে কড়াকড়ি ছিল, তাদের রক্ষণশীল অবস্থান আছে। অর্থাৎ ইরানের যে ধরনের নেতৃত্ব প্রয়োজন ছিল, ইব্রাহিম রাইসি ঠিক তেমনি এক নেতা ছিলেন। তিনি কোনো ধরনের আপস না করেই শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ইরানের ক্রমবর্ধমান উন্নত প্রযুক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেন। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক দেশটির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে যান রাইসি।