একটি দেশের আর্থিক খাতের নানান গুরুত্বপূর্ণ দিক থাকে—যেমন রাজস্ব বিষয়, মুদ্রা নীতি, ব্যাংক খাত ইত্যাদি। বৈদেশিক বাণিজ্য কার্যক্রমও আর্থিক খাতের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। আমদানি-রফতানিকেন্দ্রিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন একটি দেশের মুদ্রা সরবরাহকে প্রভাবিত করে, মূল্যস্ফীতির ওপর প্রতিক্রিয়া ফেলে।
বাংলাদেশের রাজস্ব খাতের কতগুলো কাঠামোগত দুর্বলতা সর্বজনবিদিত। আমাদের কর-জাতীয় আয়ের অনুপাত অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় তো বটেই, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও কম। এ অনুপাত ৮-৯ শতাংশের মতো। এর মানে দাঁড়াচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটা বড় অংশই কর-জালের মধ্যে ধরা পড়ছে। অথচ ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের কর-জাতীয় আয়ের অনুপাত ২২ শতাংশ হতে হবে।
আমাদের কর কাঠামোয় প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা, আয়কর এবং মূল্যসংযোজন কর উভয় ক্ষেত্রেই কর আদায়ের দুর্বলতা এ কাঠামোকে নাজুক করে রেখেছে। বাংলাদেশে আড়াই কোটি লোকের কাছ থেকে আয়কর আদায় করার কথা। দেশে ৮৭ লাখ অতিধনী আছে, তাদের মধ্যে মাত্র ৯ লাখ লোক ট্যাক্স দেয়। আয়কর ও মূল্যসংযোজন করের ক্ষেত্রে প্রচুর রেয়াত দেয়া হয়। আয়করের ক্ষেত্রেই বছরে ১ দশমিক ২৫ লাখ কোটি আয়কর ছাড় দেয়া হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট হিসাব করে দেখিয়েছে, এসব কর-ছাড় কমিয়ে আনলে কর-রাজস্ব বাংলাদেশে আগামী অর্থবছরে এবং তার পরের রাজস্ব বছরে বার্ষিক ৩০ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো সম্ভব।
মোটাদাগে যদি বলি, আমাদের ব্যাংক খাতে আমি ছয়টি সমস্যা দেখি। প্রথমত, অনাদায়ী বা খেলাপি ঋণ, যার পরিমাণ বিশাল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০২৩ সালে ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, কোনো একটি দেশের অর্থনীতি স্বাস্থ্যের অবস্থা সবল থাকলে মোট ঋণের ২ বা ৩ শতাংশের বেশি খেলাপি হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশে সেটা ৯ শতাংশ। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই ঋণ যদি অনাদায়ী থাকে তাহলে ব্যাংক খাতের আয়ে সেটা একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, ব্যাংক খাতের নাজুকতা বেড়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, ব্যাংক খাতে আয়-ব্যয়ের আমরা যে হিসাব করি তার মধ্যে নানা গরমিল উপস্থাপনা রয়েছে। আমরা জানি, ঋণের মধ্যে সুস্থ ঋণ ও বাজে ঋণ রয়েছে। বাজে ঋণগুলোকে অনেক সময় সুস্থ ঋণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বাজে ঋণগুলো যদি যথাযথ হিসাব-নিকাশে উপস্থাপিত হয়, তাহলে ব্যাংক খাতে প্রকৃত চিত্রের বদলে অন্য রকম চিত্র ফুটে উঠবে। বাজে ঋণের বিশালত্ব এবং সুশাসনের অভাব ব্যাংক খাতের অন্যতম সমস্যা।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশে সব ব্যাংকের ভিত্তিভূমি সবল নয়, সেখানে দুর্বল ভিত্তির ব্যাংকও রয়েছে। পর্যালোচিত ৫৪টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৮টি ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার প্রস্তাবও উঠেছে এবং আগামী এক বছরে ১০টি ব্যাংককে একীভূত করার একটি পরিকল্পনা রয়েছে।