বয়কট বা বর্জন শব্দের অর্থ, প্রতিবাদ করা বা শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্য, কোনো দেশ, সংগঠন বা ব্যক্তির সঙ্গে বাণিজ্যিক বা সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করা। এটি একটি অহিংস ও স্বেচ্ছামূলক পদক্ষেপ যা নৈতিক, সামাজিক বা পরিবেশগত বিবেচনায় গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বর্জনের উদ্দেশ্য হলো চিহ্নিত দেশ, সংগঠন বা ব্যক্তির আর্থিক ক্ষতিসাধন করা বা নৈতিক ক্ষোভ প্রকাশ করা যাতে বর্জনের লক্ষ্যবস্তু তার আপত্তিকর কার্যক্রম থেকে বিরত থাকে।
বয়কটরা তিন ভাই: সরকার কর্তৃক আইন দ্বারা অনুমোদিত হলে বয়কট স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞায় পরিণত হয়। এ ধরনের পদক্ষেপের ব্যাপকতম রূপ হচ্ছে একসঙ্গে বর্জন, বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও নিষেধাজ্ঞা (বয়কট, ডাইভেস্টিচার ও স্যাংশনস)। সব বয়কট আন্দোলনই সফল হয়নি। দুটি সফল বয়কট আন্দোলনের কথা নিচে উল্লেখ করছি, যা ইতিহাস বদলে দিয়েছে।
রোজা পার্কস: মন্টগোমারি বাস বয়কট আন্দোলন: ১৯৫৫ সালে, কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা রোজা পার্কস, তখনকার নিয়মানুযায়ী একজন শ্বেতাঙ্গ বাসযাত্রীকে সিট ছেড়ে দেয়ার কথা থাকলেও তা দিতে অস্বীকার করেন। এ অপরাধে তাকে বন্দি ও জরিমানা করা হয়। প্রতিবাদে শুরু হয় মন্টগোমারি বাস বয়কট আন্দোলন। এ আন্দোলনে যোগ দেন তরুণ যাজক মার্টিন লুথার কিং। যিনি পরবর্তীতে মার্কিন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন। ১৩ মাস আন্দোলনের পর মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট মন্টগোমারিকে পাবলিক বাসে গাত্রবর্ণের ভিত্তিতে বসার ব্যবস্থাকে বেআইনি ঘোষণা করে এবং তাদের বাস ব্যবস্থাকে একীভূত করার নির্দেশ দেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী বয়কট আন্দোলন: ১৯৫৯ সালে আলবার্ট লুথুলি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম লন্ডনে দক্ষিণ আফ্রিকার পণ্য বর্জনের আহ্বান জানান। প্রথমে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানীকৃত ফল, শেরি ও সিগারেট বর্জনের ডাক দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনকারীরা বর্জনীয় পণ্যের তালিকা হালনাগাদ করতে থাকে, লোকজনকে মোড়ক পড়তে এবং টেস্কো ও সেইন্সবারির মতো বড় সুপারমার্কেটগুলোকে দক্ষিণ আফ্রিকার পণ্য না রাখতে ও বিক্রি করতে এসব দোকানের সামনে ধরনা দেয়। ফলে বর্ণবাদী সরকারের পৃষ্ঠপোষক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সমর্থন সত্ত্বেও ব্রিটেনে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কাপড় আমদানি ৩৫ শতাংশ কমে যায়।
এর পরের ঘটনাপ্রবাহ বাণিজ্যিক বয়কট খেলা, একাডেমিক, এমনকি বিনিয়োগ প্রত্যাহারে গড়ায়। ১৯৬৮ সালে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলে দক্ষিণ আফ্রিকার বংশোদ্ভূত অশ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড় ব্যাসিল ডি’অলিভেরাকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী প্রধানমন্ত্রী প্রথমে ডি’অলিভেরাকে ঘুস দিয়ে তাকে টিম থেকে নাম প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেয়। তিনি অস্বীকৃতি জানালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর বাতিল করে দেয়। পরবর্তী সময়ে চাপের মুখে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বহিষ্কার করা হয়। একইভাবে ১৯৬৫ সালে জ্যাক সাইমন্স ও এডি রু নামে দুজন অধ্যাপকের ওপর তাদের বর্ণবাদবিরোধী বক্তব্যের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ৩৪টি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৯৬ জন অধ্যাপক ও প্রভাষক শিক্ষাক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বয়কটের দাবি জানায়, যা পরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে জাতিসংঘ ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অন্যান্য বয়কটের প্রস্তাব পাস করে।
এরপর আশির দশকের মাঝামাঝি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এন্ডাওমেন্ট ফান্ডের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের দাবি ওঠে। ভাসার কলেজ থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে কলম্বিয়া, মিশিগান স্টেট, হার্ভার্ড, স্মিথ কলেজসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান যোগ দেয়। ছাত্রদের প্রতিবাদ ও চাপের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইসরায়েল থেকে তাদের এন্ডাওমেন্ট ফান্ডের বিনিয়োগ আংশিক বা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে।