তার চোখ দুটি বারবার দেখছিলাম। বিপ্লবী বলেই হয়তো আগ্রহটা ছিল। শতবর্ষী নারী তখন তিনি। মুখমণ্ডলের চামড়া ভাঁজখাওয়া। চামড়ার পরতে পরতে যেন ইতিহাস লুকানো। সে ইতিহাস প্রতিবাদ, বিপ্লব আর কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের। কুমুদিনী হাজং নামটাই জানতাম। কিন্তু নানা কথা বলে সেদিন জেনেছিলাম তার আরেক নাম ‘সরস্বতী’।
কয়েক বছর আগে পুরো একটি দিন কাটে তার বাড়িতে, নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় সোমেশ্বরী নদীর পশ্চিম তীরে বহেরাতলী গ্রামে। ‘বিদ্রোহ-সংগ্রামে আদিবাসী’ নামক বইয়ের কাজের তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনেই তার কাছে ছুটে যাওয়া।
আলাপচারিতার শুরুটা হয় তার পরিবার নিয়ে
বহেরাতলী গ্রামের এক কৃষক হাজং পরিবারে কুমুদিনী হাজংয়ের জন্ম। তার বাবা অতিথ চন্দ্র ছিলেন হাতিখেদা বিদ্রোহের কর্মী। বাবার ভেতরের সেই বিদ্রোহের আগুন কুমুদিনীর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। জন্মের দুই বছরের মধ্যেই বাবা অতিথ চন্দ্র ও মা জনুমণি হাজং মারা যান। চিরকুমার এক মামার আদর-যত্নেই বড় হন কুমুদিনী। পরে তার মামা মাত্র ১১-১২ বছর বয়সে মাইঝপাড়া গ্রামের দুর্গাদাস হাজংয়ের ছোট ছেলে লংকেশ্বর হাজংয়ের সঙ্গে কুমুদিনীকে বিয়ে দেন। বিয়ের পরে কুমুদিনীর বাবার রেখে যাওয়া চার আড়া জমি ও বাড়ি বুঝিয়ে দিয়ে লংকেশ্বর হাজংকে ঘরজামাই করে নেওয়া হয়। ফলে লংকেশ্বর তখন তার পুরো পরিবার নিয়ে কুমুদিনীদের বাড়িতেই চলে আসেন। টংক আন্দোলন শুরু হলে অন্যান্য হাজং পরিবারের মতো কুমুদিনীদের পরিবারও টংক প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তার স্বামী ও চার ভাই নিয়মিত আন্দোলনের সাংগঠনিক কাজে অংশ নিতেন। কমরেড মণি সিংহের সঙ্গেও তাদের ছিল নিবিড় যোগাযোগ। এ সব কারণেই জমিদার ও ব্রিটিশ বাহিনীর রোষানল ছিল পরিবারটির প্রতি।
টংক আন্দোলনটা আসলে কি?
জানা যায়, ‘টংক’ মানে ধান কড়ারি খাজনা। জমিতে ফসল হোক বা না হোক, নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান খাজনা হিসেবে দিতেই হবে। ‘টংক’ স্থানীয় নাম। এই প্রথা চুক্তিবর্গা, ফুরন প্রভৃতি নামে ওই সময় বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত ছিল। সেই সময়কার ময়মনসিংহ জেলার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী, শ্রীবর্দী থানায় বিশেষ করে সুসং জমিদারি এলাকায় এর প্রচলন ছিল ব্যাপক।
টংকব্যবস্থায় সোয়া একর জমির জন্য বছরে ধান দিতে হতো সাত থেকে পনেরো মণ। ধানের দর হিসেবে প্রতি সোয়া একরে বাড়তি খাজনা দিতে হতো এগারো থেকে সতেরো টাকা, যা ছিল এক জঘন্যতম সামন্ততান্ত্রিক শোষণ। এ ছাড়া টংক জমির ওপরও কৃষকদের কোনো মালিকানা ছিল না। ফলে এই শোষণের বিরুদ্ধেই ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে কৃষকরা। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সুসং-দুর্গাপুরের জমিদার সন্তান কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ।
টংক আন্দোলন তখন পুরোদমে চলছে । আন্দোলনকারীদের দমাতে ময়মনসিংহ থেকে সশস্ত্র পুলিশ দল আসে দুর্গাপুরে। বিরিশিরিতে তারা একটি সশস্ত্র ঘাঁটি গড়ে। গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে সঙ্গে থাকে একজন ম্যাজিস্ট্রেটও। এরপরই ঘটে কুমুদিনীকে ঘিরে রক্তাক্ত একটি ঘটনা।