১৯৯৩ সাল। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী।সেসময় দৈনিক সংবাদপত্র পাঠ একটা রুটিন ওয়ার্ক ছিল। জগন্নাথ হলের রিডিং রুমে ‘ইত্তেফাক’ কিংবা ‘সংবাদ’ নিয়মিত পাঠ করার সুযোগ হয়। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে এই পত্রিকাগুলোর সাহিত্যপাতা আকর্ষণের বিষয় ছিল।চলছিল খালেদা জিয়ার শাসনামল।ইতিহাস বিকৃতির জোয়ারে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল দেশকে।বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চেষ্টা চলছিল। মুক্তিযুক্তের চেতনা ও মুক্তচিন্তার আঙিনায় ধর্মীয় মৌলবাদীরা জায়গা জুড়ে বসেছিল।সামাজিক জীবনে নতুন নতুন অস্থিরতার সূচনা হয়েছিল-মাদকের অবাধ অনুপ্রবেশ ঘটে। তরুণ প্রজন্মকে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর থেকে ভোগবিলাসে লিপ্ত করার নানা প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়।কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের উপর আস্থা দৃঢ় করার সকল অবৈধ কার্যসূচি বাস্তবায়ন করার পিছনে অর্থ ঢালা হচ্ছিল।সাংস্কৃতিক জীবনে মান সম্পন্ন শিল্প-সাহিত্যের বিকাশ রুদ্ধ হয়েছিল।ঠিক এই আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দৈনিক জনকণ্ঠ আত্মপ্রকাশ করে। জয় করে নেয় কোটি বাঙালি পাঠককের হৃদয়। পত্রিকাটি প্রকাশ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ এবং প্রচার করে চলেছে। পাশাপাশি পত্রিকাটি সব সময় স্বাধীনতাবিরোধীদের বিপক্ষে সরব অবস্থানে রয়েছে। তার অন্যতম প্রকাশনা হচ্ছে ‘সেই রাজাকার’।
এই বইটি দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।প্রথম থেকেই দেখা গেছে দৈনিক জনকণ্ঠ’র একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও উদার রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি পক্ষপাতিত্ব রয়েছে।জনকণ্ঠের মধ্য দিয়েই আমরা মোনাজাতউদ্দিনের(১৯৪৫-১৯৯৫) মতো বিখ্যাত চারণ সাংবাদিক ও লেখকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি।১৯৯৫ সালের মাঝামাঝি তিনি দৈনিক জনকণ্ঠে সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। এরপর তিনি তাঁর প্রতিবেদনের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনকে শহরবাসীর কাছে তুলে ধরার মহৎ কাজটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল কাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও দুর্ভোগের চিত্র নিবিড়ভাবে লেখনিতে তুলে ধরেছেন।১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর নদীতে ফেরি দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান।তাঁর সংবাদটি পাঠকদের শোকে স্তব্ধ করে দেয়।জনকণ্ঠ নিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত একটি উদ্ধৃতি স্মরণীয়-‘‘মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরের অকুতোভয় গেরিলাযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ মূলত তিনটি নীতির ভিত্তিতে দৈনিক জনকণ্ঠ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। একটি হচ্ছে তিরিশ লাখ শহীদের আত্মাহুতির মহাকাব্য মহান মুক্তিযুদ্ধকে সমুজ্জল রাখা এবং দ্বিতীয় হলো মুক্তিযুদ্ধের মূল নীতি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং তৃতীয়টি হলো দেশের তৃণমূল মানুষের কাছে দিনের পত্রিকা দিনেই পৌঁছে দেওয়া।
যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে নব্বইয়ের দশকেও দেশের তৃণমূল পর্যায়ে পত্রিকা পৌঁছাতে দুই থেকে তিনদিন লেগে যেত। তাই পত্রিকা প্রকাশের আগে দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ চিন্তা করেন কীভাবে দিনের পত্রিকা পাঠকের হাতে দিনেই পৌঁছে দেয়া যায়। সেই নীতির আলোকেই মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে ১৯৯২ সালে শুরু হয় দেশের পাঁচ বিভাগীয় শহর থেকে দৈনিক জনকণ্ঠ প্রকাশের উদ্যোগ। দেশ তখনও ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেনি, ছিল না কোন ইন্টারনেট ব্যবস্থা। এমনকি, কম্পিউটার ব্যবহারও ছিল সীমিত পর্যায়ে। ওই সময়ে দেশের পাঁচটি স্থান থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে নতুন একটি চাররঙা দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ ছিল দুঃসাহসিক উদ্যোগ। আবার ঝুঁকিও ছিল অনেক। সাহসিকতার সঙ্গে সেই ঝুঁকি গ্রহণ করেছিলেন সংবাদপত্র প্রকাশের অগ্রসেনানী আতিকউল্লাহ খান মাসুদ। ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সেই উদ্যোগ বাস্তবায়িত করে তিনি বাংলাদেশের মিডিয়া জগতে পুরনো গতানুগতিক ধাঁচ উপড়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেশের পাঁচটি বৃহত্তর বিভাগীয় শহর থেকে একসঙ্গে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে দেশের সংবাদ মাধ্যমে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করেছিল দৈনিক জনকণ্ঠ। রঙিন এই পত্রিকাটি প্রকাশ শুরু হয়েছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া ও সিলেট থেকে। বগুড়া বিভাগীয় শহর না হলেও এটি হচ্ছে উত্তরবঙ্গের কেন্দ্রবিন্দু। এ কারণেই রাজশাহীর পরিবর্তে বগুড়াকে বেছে নেওয়া হয়েছিল উত্তরবঙ্গের বিভাগীয় শহর হিসেবে।