কয়েক দিন আগের কথা। প্রতিদিনের মতো সেদিন সকালেও পা বাড়িয়েছিলাম অফিসের পথে। কিন্তু রোজকার পথে বাধা পড়ল। রাস্তা কাটা হয়েছে। পাশে ছোট সাইনবোর্ডে লেখা, ‘রাস্তার উন্নয়নকাজ চলছে।’ অগত্যা পথ পরিবর্তন করতে হলো।
মোহাম্মদপুর এলাকার জন্য রাস্তা কাটাছেঁড়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। রাস্তা কাটাকাটিতে যদি কোনো পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকত, আমি নিশ্চিত মোহাম্মদপুর অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে প্রতিবছরই সেরা পারফরম্যান্সের পুরস্কারটি পেত। যা–ই হোক, কিছুদূর এগিয়ে যেতেই একঝাঁক শিশু আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
দেখলাম, তারা রাস্তার সঙ্গে লাগানো একটি স্থাপনার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা কেউ নড়াচড়া করছে না। কারণ, নড়াচড়া করলেই রাস্তার পাশে খুঁড়ে রাখা গর্তে নিশ্চিত পড়ে যাবে ওরা।
ভাবছিলাম এত ঝুঁকি নিয়ে ওদের এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ কী! আগ্রহী হয়ে গাড়ির জানালার কাচ খুলতেই ভেসে এল জাতীয় সংঙ্গীতের সুর। বুঝলাম স্কুলের অ্যাসেম্বলি চলছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের বিবেচনাবোধ দেখে স্তম্ভিত না হয়ে পারলাম না। স্কুলের অভ্যন্তরে এমনকি ক্লাসরুমেও কি সামান্য জায়গাটুকু নেই?
দুই.
আরেক দিন অফিস থেকে ফেরার পথে বাসার কাছাকাছি চোখে পড়ল একদল শিশু। ওরা সবাই তায়কোয়ান্দোর পোশাকে সজ্জিত। ওরা যে ভবন থেকে নেমে এসেছে, সেখানে খাবার রেস্টুরেন্ট, বিউটি পারলার, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, ডেন্টাল কেয়ার, জিমসহ সব ধরনের বন্দোবস্ত আছে। ভবনের প্রবেশমুখে অনেকগুলো রিকশা এমন এলোমেলোভাবে রাখা যে শিশুদের বের হয়ে আসা কঠিন।
লক্ষ করলাম একটি রিকশার হাতলের সঙ্গে আটকে গেছে এক শিশুর তায়কোয়ান্দোর ঢোলা পোশাক। ওদিকে রিকশাওয়ালা প্যাডেল চেপে সামনে এগোতে শুরু করেছেন। বিষয়টি লক্ষ করে শিশুটির অভিভাবক পাশ থেকে ছুটে এলেন। তাঁর চেঁচামেচিতে অল্পের জন্য বড় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেল শিশুটি।
তিন.
৯ বছরের অন্তু (ছদ্মনাম) খেলাধুলা করতে খুব পছন্দ করে। ফুটবল তার সবচেয়ে প্রিয়। রোজ বিকেলে বাংলাদেশের জার্সি আর বুট পরে আশপাশের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতে নামে সে। দুই বাসার মাঝখানে থাকা একচিলতে জমিতে প্রতিদিন বিকেলে জমে ওঠে ওদের খেলা। অন্তু ইদানীং আর খেলতে পারছে না। কারণ, সম্প্রতি ওয়াসা অন্তুদের খেলার সামান্য জায়গাটুকু অধিগ্রহণ করেছে। সেখানে এখন পানির পাম্প বসানোর কাজ চলছে। অন্তু রোজ বিকেলে ছটফট করে খেলার জন্য। সে ছলছল চোখে মাকে প্রশ্ন করে, ‘আমি কোথায় খেলতে যাব মা?’
এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই মায়ের। অন্তুর কান্না ভিজিয়ে দেয় মায়ের দুই চোখ। অন্তু এখন ইউটিউবে দেশের বাইরের শিশুদের ফুটবল খেলা দেখে। ভিডিওর সেই শিশুরা পরিপাটি হয়ে বাসার পাশের ছোট্ট সবুজ লনে বা আঙিনায় ফুটবল খেলে। আর অন্তু বড় বড় চোখে তাদের খেলা দেখে নিষ্পলক।