স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিবস ১৭ মার্চ। দিবসটির যথাযথ মর্যাদায় উদ্যাপিত হচ্ছে।
বাঙালির মুক্তি আন্দোলন তৃতীয় বিশ্বের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অন্তর্গত, সে আন্দোলনের অবিচ্ছিন্ন স্রোতোধারা। ১৯৭১-এর ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ প্রশ্নে বিতর্কের সময় সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ইয়াকফ মালিক বলেছিলেন, বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা তৃতীয় বিশ্বের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের আরেকটি প্রকাশ, এর আর অন্য কোনো পরিচয় নেই। এ গণমুক্তি আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ফলে, মোটেই বিস্ময়ের কথা নয় যে মুক্তিপ্রয়াসী মানুষ—তা তারা যেখানেই থাকুক—তাঁর জন্মদিবস উদ্যাপনে আগ্রহী হবে।
অনুমান করি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ উদ্যাপনের কেন্দ্রে থাকবে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম অথবা অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কাজের সঙ্গে পরিচিত হতে এ–জাতীয় অনুষ্ঠানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা আনুষ্ঠানিকতা ও সরকারি আচার–অনুষ্ঠান-ক্রিয়াকর্মেই সীমাবদ্ধ থাকে। সব সময় সে অনুষ্ঠানের কোনো স্থায়ী প্রভাব থাকে, তা মনে হয় না।
আরও একভাবে দিবসটি উদ্যাপন সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ ও কীর্তির প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমরা এই দিন কিছুটা সময় স্বেচ্ছাশ্রমে ব্যয় করতে পারি। দিবসটি উদ্যাপন করতে পারি জাতীয় সেবা দিবস হিসেবে। খুব বেশি সময় নয়, এই দিন মাত্র ২৪ মিনিট সময় স্বেচ্ছাশ্রমে ব্যয় করার আবেদন রাখছি। বাঙালি জাতির জনক তাঁর জীবনের ১২ বছর কারান্তরালে ছিলেন। আরও ১২ বছর কাটিয়েছেন পুলিশি নজরদারিতে।
এই ২৪ বছর, যা কার্যত তাঁর জীবনের প্রায় অর্ধসময়—তিনি বাঙালি জাতির মুক্তি অন্বেষণে ব্যয় করেন। সে ত্যাগের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ন্যূনতম যা আমরা করতে পারি তা হলো, তাঁর জন্মদিনে মাত্র ২৪ মিনিট ব্যয় করা, যার লক্ষ্য হবে সাধারণের কল্যাণ হয়, এমন কোনো কাজে আত্মনিয়োগ।
আমি মোটেই কোনো অভিনব প্রস্তাব রাখছি না। বিশ্বের অনেক দেশেই জাতীয় নেতার স্মরণে সেবা দিবস পালনের চল রয়েছে। প্রতিবেশী ভারতে মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে অনেক স্কুল-কলেজ স্বেচ্ছাশ্রমভিত্তিক উদ্যোগ নিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে মার্টিন লুথার কিং দিবসকে পরিণত করা হয়েছে জাতীয় সেবা দিবস হিসেবে। দক্ষিণ আফ্রিকার মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন ১৮ জুলাই শুধু সে দেশে নয়, সারা বিশ্বেই সেবা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে থাকে।
নানাভাবে ম্যান্ডেলা ও বঙ্গবন্ধুর জীবনে মিল রয়েছে। তাঁদের ব্যক্তিগত ত্যাগ ও আপসহীন নেতৃত্ব শুধু এই দুই দেশের মানুষ নয়, সারা বিশ্বের মানুষকেই অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁদের জন্মদিনের উদ্যাপন এ কারণে জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক চরিত্র গ্রহণ করেছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে ‘বঙ্গবন্ধু সেবা দিবস’ হিসেবে উদ্যাপনের ধারণাটি মুখ্যত ম্যান্ডেলা দিবস উদ্যাপনের মডেলটি মাথায় রেখে। ২০০৯ সাল থেকে জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুসারে দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে উদ্যাপিত হচ্ছে, এর মূল লক্ষ্য, ম্যান্ডেলার স্মৃতির সম্মানে স্বেচ্ছাশ্রমে ব্রতী হওয়া। বিশ্বকে মানবের জন্য অধিক বাসযোগ্য করার ক্ষমতা আমাদের হাতের মুঠোয় রয়েছে, এ কথা ম্যান্ডেলা বলেছিলেন।
শুধু বলেননি, আমৃত্যু সে কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। যার যার নিজের দেশে, নিজের গ্রামে অথবা নিজের পাড়াকে অধিক বসবাসযোগ্য করে তুলতে আমরাও হাত লাগাতে পারি। প্রতিদিনই, বছরের যেকোনো দিনই করতে পারি। ম্যান্ডেলার জন্মদিনে করা হলে সে কাজ একটি প্রতীকী অর্থ গ্রহণ করে। সে জন্যই জাতিসংঘ দিবসটিতে সবাইকে স্বেচ্ছাশ্রমে আহ্বান জানিয়েছিল।