সাম্প্রতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় যে এনআরবি ব্যাংকের এমডি অপ্রত্যাশিতভাবে পদত্যাগ করেছেন। কিছুদিন আগে এভাবেই তিনটি ব্যাংকের এমডি একের পর এক পদত্যাগ করেছিলেন। তার আগে আরো একটি ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করেছিলেন। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিয়ে তিনজন এমডিকে স্বপদে ফিরিয়ে এনেছিল বলেই শুনেছিলাম। একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বা এমডি পদত্যাগ করতেই পারেন। স্বাস্থ্যগত কারণ, পারিবারিক কারণ বা দায়িত্বের চাপ অস্বাভাবিক মনে হলে তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দিতেই পারেন, যা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটে তখনই যখন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং প্রধান নির্বাহীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় বা যখন ব্যাংকের এমডির ওপর পরিচালনা পর্ষদ নিয়মবহির্ভূত চাপ প্রয়োগ করে। আমাদের দেশের ব্যাংকের এমডির পদত্যাগের নজির খুব একটা নেই। আমাদের ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা অনেক অযাচিত চাপ সহ্য করেই দায়িত্ব পালন করেন। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় আমাদের দেশের ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং পরিচালকদের মন জুগিয়েই ব্যাংক পরিচালনা করে থাকেন। এজন্য তাঁদের অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। এরকম একটি অবস্থায় যখন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা অপ্রত্যাশিতভাবে পদত্যাগ করেন তখন এর পিছনে সংকট যে বেশ জটিল তা আর বুঝতে বাকি থাকে না।
ব্যাংকের এমডির অপ্রত্যাশিত পদত্যাগ মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। এই ঘটনা একদিকে যেমন দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য ক্ষতিকর, অন্যদিকে তেমনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও আমাদের দেশের ব্যাকিং খাত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেয়, যার প্রভাব দেশের ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর পড়তে বাধ্য। দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য ক্ষতিকর এই কারণে যে এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সমগ্র ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে। অন্যান্য ব্যাংকের এমডিও তখন স্বাচ্ছন্দে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ ব্যাংকাররা এই পেশায় ক্যারিয়ার গড়ে তোলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। এমনকি ব্যাংকাররা পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে দায়িত্ব পালনেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, কারণ বিশ্বের ব্যাংকিং পেশার যেসব প্রকাশনা আছে, সেখানে এই সংবাদ ছাপা হবে যা নেগেটিভ নিউজ আকারে বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক লিপিবদ্ধ করে রাখবে। ফলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, যার খেসারত দিতে হবে দেশের ব্যবসায়ীদের।
আমাদের সবার একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, ব্যাংকিং কোনো সাধারণ পেশা নয়। চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা আইনজীবীর মত ব্যাংকিং একটি বিশেষায়িত পেশা। একজন চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা আইনজীবী রাতারাতি গড়ে তোলা যায় না। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘ পড়াশোনা, অনুশীলন এবং অঙ্গীকার। ব্যাংকিং পেশাও ঠিক তাই। অনেক পড়াশোনা, হাতেকলমে কাজ করা এবং সর্বোপরি পেশার প্রতি কঠোর অঙ্গীকারের (কমিটমেণ্টের) মাধ্যমে একজন ব্যাংকার তৈরি হতে পারে। একথা ঠিক যে সব ব্যাংকার সমান দক্ষ ও অভিজ্ঞ হবেন তেমন কোনো কথা নেই। সেরকম অবস্থা কোন পেশাতেই হয় না। তবে দক্ষতা অভিজ্ঞতা যাই থাকুক না কেন একজন ব্যাংকারকে দীর্ঘদিন হাতেকলমে কাজ করেই এই পেশায় পারদর্শী হতে হয়। আর একারণেই ব্যাংকারদের দিয়েই ব্যাংক পরিচালনা করতে হয়। উন্নত বিশ্বে ব্যাংকিং সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর এক ব্যাবসায় পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রযুক্তিবিদদের রমরমা অবস্থা। তারপরও ব্যাংকারদের কদরই এখনও সবার উপরে। তাই একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ব্যাংক চালাতে হলে ব্যাংকার লাগবে, অন্য কাউকে দিয়ে হবে না। আর ব্যাংকার তৈরি করতে হলে নির্ভয়ে ব্যাংকারদের কাজ করতে দিতে হবে এবং সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
আলোচনা সমালোচনা যাই থাকুক না কেন আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে ব্যবসায়ীদের যথেষ্ট অবদান আছে। ব্যবসায়ীরাই ঝুঁকি গ্রহণ এবং পুঁজি বিনিয়োগ করেন, তাই তাঁরাও তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সফলতার সঙ্গেই পরিচালনা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। দেশের ব্যবসায়ীরাই ব্যাংকের মালিক তাই তাঁরা এই প্রতিষ্ঠানকে সফলভাবে পরিচালনা করবেন এটাই স্বাভাবিক। ব্যাংক সফলভাবে পরিচালনার জন্য যে ভালো ব্যাংক কর্মকর্তা লাগবে সেটাও তাঁরা ভালভাবেই জানেন। তাহলে কেন এমন পরিস্থিতির উদ্রেগ হবে যে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের দায়িত্ব ছেড়ে চলে যেতে হবে। এই অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে তো দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যাংক পরিচালনার জন্য যোগ্য ব্যাংকার খুঁজে পাবেন না।