ষাটের দশকে বদরুদ্দীন উমর একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকটের কথা বলেছিলেন। পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে একটা বড় দ্বিধা ছিল, তা হলো ‘আমরা বাঙালি নাকি মুসলমান!’ সেই ষাটের দশকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এমন একটা পর্যায়ে চলে গেল যে এই দ্বিধা আর মুখ্য রইল না। বাঙালি আন্দোলন-সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটা স্বাধীন ভূখণ্ড নির্মাণের গৌরব অর্জন করল। দেখা গেল, শহরের বিপণিকেন্দ্রগুলোর সব সাইনবোর্ড বাংলায় হয়ে গেল। সব নিমন্ত্রণপত্র বাংলায়, পোশাক-আশাকে এমনকি খাদ্যাভ্যাসেও বাঙালি সংস্কৃতি।
এর বহু আগে মুসলমানরা পিছিয়েই ছিল। ইংরেজি শিক্ষায় বেশ পিছিয়ে, আধুনিক শিক্ষায়ও। ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় ভাগে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ভারতের মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজি ও আধুনিক শিক্ষার একটা জাগরণ লক্ষ করা যায়। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকদের ধর্মভিত্তিক ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ চালু থাকায় মুসলমানদের উসকানিদাতা হিসেবে একটা গোষ্ঠীর অস্তিত্ব থেকেও গেল, হিন্দুদের ক্ষেত্রেও তাই। তাই ছোটখাটো ঝগড়া-ফ্যাসাদ, দাঙ্গা থেকে বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাটি হয়ে গেল। দেশভাগের পর থেকে এই উসকানি রয়েই গেল।
কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর যখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হলো, তখনই বাঙালি ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঙালিত্বের আশ্রয় নিল। এ সময় শিল্পী, সাহিত্যিক, ছাত্র থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও সাম্প্রদায়িক সংকটের বেড়াজাল থেকে কিছুটা মুক্তি পেল বটে, কিন্তু রাজনীতিতে এই মেঘ কিছুতেই কাটল না। তাই অগণতান্ত্রিক পথকেই বেছে নিল পাকিস্তান। সামরিক শাসন জারি করে ভিন্ন পথে পা বাড়াল। মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে দেশ শাসনের পথে পা বাড়াল বটে, কিন্তু তাতে অসাম্প্রদায়িক শক্তিরই সুবিধা হলো। এ সময় রাজপথের আন্দোলনের মূল প্রেরণা ছিল বাংলার সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতি অসাম্প্রদায়িক।
দেশ স্বাধীনের পরও ওই সাম্প্রদায়িক শক্তির বিনাশ হলো না। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সামরিক শাসনের হাত ধরে সেই অপশক্তি আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এই শাসনের ফলে সাম্প্রদায়িক শক্তি দেশ শাসনের অংশীদারত্ব পেয়ে যায়। এ সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে গ্রামেগঞ্জে ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা বেশ শিকড় গেড়ে ফেলে। সংস্কৃতির প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বদলে জাতি বিভক্ত হয়ে যায়। এই বিভক্তি কালক্রমে একধরনের ভিন্ন সংস্কৃতির পথ প্রশস্ত করে। শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তৃতিতে অতি সন্তর্পণে কাজ করতে থাকে ওই শক্তি।