বাংলাদেশের উন্নয়ন গল্প নিয়ে রচিত বই, গবেষণা প্রবন্ধ, পত্রিকায় লেখালেখি ও বক্তৃতা-বিবৃতির কোনো অভাব আছে বলে মনে হয় না এবং ওই সবকিছুতে বিধৃত ইতিবাচক বিবর্তন সম্পর্কে কোনো বিতর্ক আছে বলেও ঠাহর হয় না। তবে স্বীকার্য যে সমাজবিজ্ঞানীদের এসব পর্যালোচনায় উন্নয়নে নারীর ভূমিকা নিয়ে তথ্যবহুল লেখা খুব কম। লেখা নেই বললেও বোধ করি অত্যুক্তি হবে না। অথচ শুরু থেকে উন্নয়নের নাড়িতে যে নারীও ছিল, সে গল্পটা অধরা রয়ে যায়, যেমন নারীর অবদান স্বীকৃত নয় অন্যখানে, ঘরে তো বটেই।
তবে খরা কাটালেন পপুলেশন কাউন্সিলের সাজেদা আমীন, বিআইডিএস আয়োজিত এক কনফারেন্সে। সম্প্রতি তিনি তার এক গবেষণা প্রবন্ধে বাংলাদেশের সফল উন্নয়ন গল্পের পরিপ্রেক্ষিতে নারীর ভূমিকা অনুসন্ধান করেছেন। তবে ক্ষমতায়নের মতো জটিল বিষয়ে ব্যাপৃত না থেকে তিনি অন্তর্ভুক্তি এবং অংশগ্রহণকে প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। সাজেদা আমীন মূলত কয়েকটি প্রশ্নের প্রায়োগিক মূল্যায়ন উপস্থাপন করেছেন। যেমন ক. বাংলাদেশের উন্নয়ন কি নারীদের সম্পৃক্ত করতে পেরেছে? খ. অতিসাম্প্রতিক প্রবণতা কি নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়? গ. বাংলাদেশের উন্নয়ন সফলতায় কি নারীর ক্ষমতায়ন দরকারি?
প্রসঙ্গত বলে নেয়া দরকার যে নারীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টা গৃহীত উন্নয়ন কৌশলে প্রাথমিক প্রাধান্য ছিল না। তবে দেখা গেছে যে ইচ্ছাকৃত বা অন্যভাবে উন্নয়ন অগ্রাধিকার নারীকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। অনেক ক্ষেত্রে নারীর নিয়োগের পেছনে সচেতন অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্দেশ্যের চেয়ে নারীর উপযুক্ততা কাজ করেছে বেশি। এটা সুবিধাভোগী নারী হিসেবে যেমন সত্য ছিল, তেমনি সত্য উন্নয়নের এজেন্ট হিসেবে নারীর ক্ষেত্রেও।
উন্নয়ন কর্মশক্তিতে নারীর অন্তর্ভুক্তির শুরু সত্তর দশকে। তখন স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা উন্নয়নমূলক কাজের প্রধান ক্ষেত্র ছিল। সেবা সরবরাহের প্রধান মাধ্যম ছিল কমিউনিটি আউটরিচ। বিশেষ প্রকল্পে প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ দিয়ে টিকা এবং পরিবার পরিকল্পনা ব্যবহারে নারীদের উৎসাহিত করা হতো। এ কাজের জন্য নারী পরিবার পরিকল্পনা কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। ওই সময়কার নারীদের ভূমিকা নিয়ে বলা হয় যে প্রধান উন্নয়ন কৌশল প্রণয়নে নারী অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তবে উন্নয়ন কৌশলগুলো গুরুত্বপূর্ণভাবে নারীদের মধ্যস্থতাকারী (মেডিয়েটর ) হিসেবে সুযোগ প্রদান করে। আর এ মধ্যস্থ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ দায়িত্ব বা নেতৃত্বে না থাকলেও নারীদের জন্য একটা প্রধান ভূমিকা পালনে সাহায্য করে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যেখানে পর্দাপ্রথা, শ্রমবাজার এবং নেতৃত্বে অসম্পৃক্ততার জন্য নারী অদৃশ্যমান, সেই অবস্থায় সামাজিক পরিবর্তন বিশ্লেষণে একটা ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়।
নব্বই দশকের শুরুর আগ পর্যন্ত পরিবার পরিকল্পনা ব্যবহারে নারীদের উৎসাহী করতে নারী কর্মীদের সফলতা যথেষ্ট নথিভুক্ত হয়নি এবং স্বীকৃতি পায়নি। তবে পরবর্তীকালে সফলতার সঙ্গে দুর্গম অঞ্চলে, রক্ষণশীল পারিবারিক পরিবেশে, নারীদের আস্থা অর্জন করে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক সেবাদানের কাজে পৌঁছার জন্য নারী মাঠ কর্মী যে চাবিকাঠি ছিল, সে ধারণা পাওয়া গিয়েছিল অনেক আগেই। অব্যবহিত এবং স্বল্পকালীন এমন প্রভাবের বাইরে টেকসই পরিবর্তনপ্রত্যাশী মেয়ে এবং যুবা নারীদের কাছে পরিবার পরিকল্পনার সেবায় নিয়োজিত নারী কর্মীরা রোল মডেল হিসেবে ধরা দেয়।