নতুন বছর অন্যান্য বছরের মতোই ভালো-মন্দতে সবার কাটবে এতো বলাই বাহুল্য। গত বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার এক বন্ধুর পাঠানো ছোট্ট একটা খবরে চোখ আটকে গেল। কলকাতা করপোরেশন তাদের মুখপাত্র পুরশ্রী’র আগামী সংখ্যা উৎসর্গ করছে অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলিম মেয়র শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের নামে।
তার সম্পর্কে লেখা, তার একাধিক বক্তৃতা নতুন ছাপানোর যে উদ্যোগ পুরসভা নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য। ১৯৩৫ সালে এমন এক সময়ে ফজলুল হক মেয়র হয়েছিলেন তখন চারপাশের পরিস্থিতি ক্রমেই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছিল। হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটছিল। ফজলুল হক কিন্তু ছিলেন পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক। ফজলুল হকের শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ভাষায়, ফজলুল একাধারে খাঁটি মুসলমান, অন্যদিকে খাঁটি বাঙালি। তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক। প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও ‘বাংলার বাঘ’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের স্নেহধন্য ফজলুল, কমিউনিস্ট নেতা মুজাফফর আহমেদ ও বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের নবযুগ পত্রিকার অভিভাবক, বিশিষ্ট আইনজীবী, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক নানান প্রতিষ্ঠানের প্রাণ।
দেশভাগের পরে বাধ্য হয়ে তাকে পূর্ব বাংলায় চলে যেতে হলেও তিনি কখনো এই বঙ্গকে ভোলেননি। দেশ বিভাজনের পর কলকাতায় এলে তিনি এমনিই আবেগাপ্লুত হয়ে দুই বঙ্গের মিলন ও ঐক্য নিয়ে কথাবার্তা বলতেন যা নিয়ে পাকিস্তান শাসক ও অন্যান্য পাক সমর্থকদের রোষের মুখে তাকে পড়তে হতো। আজকের হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির প্রোপাগান্ডা যাই বলুক না কেন তিনি ছিলেন যুক্তবঙ্গের সমর্থক। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের পরপরই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের মতিগতি। পূর্ব বাংলাকে নতুন উপনিবেশ বানানোর প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালেই যখন বিরোধী আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হলো মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে, তখন শের-ই বঙ্গাল নতুন দলকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন নিজস্ব স্টাইলের জ্বালাময়ী ভাষণে। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন বা ১৯৫৪ সালে সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী ও ফজলুল হকের সম্মিলিত যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক ভূমিকা তো ভোলার নয়।
তারও আগে যদি সত্যি কথা বলতে হয়, তাহলে মুসলিম লীগ তো ছিল এলিট আশরাফদের। নবাব, জমিদার, ব্যারিস্টার নীল রক্তের উচ্চবর্গের। লীগকে তৃণমূল স্তরে নিয়ে আসার পেছনে তো ছিলেন ফজলুল হক, আবুল হাশিম ও মওলানা ভাসানী। দলে দলে কৃষক ও অন্যান্য পেশার গরিব মুসলমান লীগের শ্রেণি চরিত্র পাল্টে দিয়েছিলেন। সেখানে ধর্মের নামে অধিকার আন্দোলন অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। আমরা মনে রাখিনি যে ফজলুল হক প্রথম বিধানসভার যুক্ত কক্ষে বাংলায় বক্তব্য রাখতে উৎসাহ দিতেন সদস্যদের। তিনিই প্রথম বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছিলেন অখণ্ড বঙ্গে।
বরিশালের সম্পন্ন পরিবারের ছেলে ফজলুল হকের মেধার বিকাশ এই কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের তুখোড় ছাত্র, পরবর্তী সময়ে আইন পাস করে কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করে অল্প দিনেই পসার জমিয়ে অনেককে তাক লাগিয়ে দিলেন। ফজলুল হক কোর্ট রুমে বিপক্ষকে ঘায়েল করতে ইংরেজির সঙ্গে এমন সব বাংলা গ্রাম্য দেশজ শব্দ জুড়ে দিতেন তা মুগ্ধ করত বিচারপতিদের পর্যন্ত। সেই সঙ্গে ছিল তার অননুকরণীয় উইট বা শ্লেষ। ১৯৫৪ সালের মুসলিম লীগকে ধরাশায়ী করার পেছনে ফজলুল হকের বিরাট অবদান ছিল সে তো সবার জানা। সে সময় যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী সভায় শেরেবাংলার একটি বক্তব্য এখনো অনেকেই মনে রেখেছেন। গ্রাম্য কৃষকদের এক সভায় তিনি বলতে উঠেই বললেন, ‘বাবা সকল আমার তো অনেক বয়েস হলো তোমরা দেখতেই পাচ্ছো। এই বয়সে আমার কবরে থাকার কথা। আল্লাহ চাননি বলেই আমি এখনো মরি নাই। আল্লাহ চান, আমি আরও কিছুদিন বেঁচে মুসলিম লীগের জালিমদের কবরে পাঠাই। আল্লাহর ইচ্ছে তালিম করতেই আমি আপনাদের কাছে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীকে জেতাতে ভোট চাইতে এসেছি।’ বলাই বাহুল্য ওই কেন্দ্রে সেবার লীগ প্রার্থীর হার হয়েছিল বিপুল ভোটে।