বাংলাদেশ আয়তনে একটি ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখানে ১৭ কোটি মানুষের বসবাস। জীবন-জীবিকার পাশাপাশি আমাদের সার্বিক উন্নয়নে কৃষি অনাদিকাল থেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩ শতাংশেরও বেশি। কৃষি খাতে কর্মসংস্থান প্রায় ৩৭ শতাংশ। বাংলাদেশ বর্তমানে ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে। নানা ধরনের শাকসবজি ও সুস্বাদু ফল উৎপাদনেও অনেক এগিয়ে। মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দশম। ফিশারিজ ও চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান যথাক্রমে তৃতীয় ও পঞ্চম স্থানে। বিশ্বব্যাপী মাংস উৎপাদনে পোলট্রি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও দ্রুতবর্ধনশীল খাত। এ খাতও জিডিপিতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। বেকারত্ব নিরসন ও নারীদের স্বাবলম্বী করার অন্যতম এক হাতিয়ার এখন পোলট্রি পালন।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফসল উৎপাদনে বেড়েছে খামার-যন্ত্রপাতির ব্যবহার। বিশেষ করে উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সরবরাহ ব্যবস্থায় খামার-যন্ত্রপাতির ব্যবহারের ফলে কম খরচ ও কম সময়ে ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। ১৯৯০ সালের পর খামার-যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়েছে ব্যাপকভাবে। বেড়েছে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, পাম্প, থ্রেসার, স্প্রেয়ার, কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও রিপারের ব্যবহার। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু কৃষিবিপ্লবের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাই তিনি কৃষিক্ষেত্রে সেচের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে নগদ ভর্তুকি ও সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে কৃষকের মধ্যে সেচযন্ত্র বিক্রির ব্যবস্থা করেন। গভীর নলকূপ ও ভূ-উপরস্থ সেচ ব্যবস্থার প্রবর্তনের মাধ্যমে শুকনো মৌসুমে বোরো ধানের উৎপাদন বেড়েছে।
সামগ্রিক অগ্রগতির পরও গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর প্রায় ০.৫৪ শতাংশ চাষযোগ্য কৃষিজমি বিভিন্ন অবকাঠামো, বসতবাড়ি, কল-কারখানা ইত্যাদি নির্মাণের কারণে অকৃষি জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে, যার ফলে দেশের প্রধান খাদ্য চাল উৎপাদনে ক্ষতি হচ্ছে ০.৮৬ থেকে ১.১৬ শতাংশ। আবাদি জমি হ্রাস পাওয়ায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটানো এখন সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ঘাটতির জন্য শস্য বৈচিত্র্য ও শস্য নিবিড়তা সব জায়গায় সমানভাবে হয়নি। গবেষকরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রক্রিয়ায় ২০৬০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান ফসলগুলোর ফলন ব্যাপকহারে হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভোগের মাত্রা বাড়ছে। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ২০৫০ সালে ২৫ কোটিতে উপনীত হবে। ক্রমবর্ধমান এ জনসংখ্যার জন্য খাদ্য চাহিদা বাড়বে, সেই সঙ্গে বাড়বে আমদানিনির্ভরতাও, যদি না আরেকটি ‘সবুজবিপ্লব’ সংঘটিত করা যায়।
কৃষিজমির ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন ক্ষমতা, জলবায়ুর পরিবর্তন, সেচের পানির স্বল্পতা, সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা লোনা জলে আক্রান্ত হওয়া, ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধি, শিল্পায়নজনিত দূষণ, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ও প্রসার ইত্যাদি কারণে কৃষিপণ্য উৎপাদনের ওপর পড়বে ব্যাপক চাপ। সেই সঙ্গে রয়েছে শ্রমের মজুরি বৃদ্ধি ও শস্য উৎপাদন লাভজনক না হওয়ার কারণে কৃষিজমি প্রতিনিয়ত অকৃষি জমিতে রূপান্তরিত হওয়া। দেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১ শতাংশ করে কৃষিজমি বিভিন্ন কারণে হ্রাস পাচ্ছে। যদিও আধুনিক প্রযুক্তি, উচ্চফলনশীল জাত ইত্যাদি কারণে ধান উৎপাদন অদ্যাবধি বেড়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি একক জমিতে ধানের ফলন সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে। কৃষিপণ্যের ফলন ও মোট উৎপাদন বৃদ্ধি তথা উৎপাদনকে টেকসই করার জন্য প্রয়োজন অধিকতর উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, সেচের পানির ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার, দক্ষ জমি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। কৃষিকে লাভজনক করার মাধ্যমে সবার খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে সরকার গ্রহণ করেছে ‘বিশেষ কর্মপরিকল্পনা’। তবে তা বাস্তবায়নে যেসব বাধা রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কৃষিপণ্য পরিবহণ ও বাজারজাতকরণে তুলনামূলকভাবে দুর্বল ব্যবস্থাপনা।
কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা সুরক্ষিত করার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধিই কি শেষ কথা? উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে ধরে নেওয়া হলেও কিন্তু তা কি ভোক্তাদের পর্যাপ্ত ভোগের নিশ্চয়তা দেবে? উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ সমস্যার সমাধানে কোনো দীর্ঘকালীন পদক্ষেপ না নেওয়া হলে উৎপাদন বৃদ্ধির ফলাফল অংশীদারত্বমূলক হবে না, কৃষি অলাভজনক পেশা হিসাবেই বিবেচিত হতে থাকবে। কৃষির উৎপাদন বেড়েছে, মূল্য সংযোজন হয়েছে, তবুও কৃষি তুলনামূলকভাবে অলাভজনক ব্যবসা হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে, কারণ কৃষক অনেক সময়ই তার উৎপাদিত পণ্যের লাভজনক দাম পাচ্ছে না।