বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আমরা একক একটি যুদ্ধ বলে ধরে নিই। মনে করি যে সকল মানুষের একই ধরনের প্রতিশ্রুতি ছিল। আদতে কোনো মুক্তিযুদ্ধের একক প্রতিশ্রুতি হয় না। বস্তুত আমাদের দেশে ইতিহাসচর্চা বা ইতিহাস ভাবনার বড় সমস্যা আমরা ভাবি মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি সবার জন্য একইভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিবিধ একটি ঘটনা। আমরা এই বিবিধ ঘটনাকে ইতিহাসচর্চায় বিভিন্নভাবে অস্বীকার করি। এর ফলে আমরা ভাবি যে কৃষক যুদ্ধ করতে গিয়েছিল, কিংবা যে রাজনীতিবিদ যুদ্ধ করতে গিয়েছিল, যে সেনাবাহিনীর লোক যুদ্ধ করতে গিয়েছিল– তাদের সকলের ইচ্ছা একইরকম ছিল। যে জায়গায় তাদের ইচ্ছাটা একই ছিল, সেটা ঘৃণার জায়গায়। অর্থাৎ পাকিস্তান বাহিনীকে আমি ঘৃণা করি এবং তাদের হত্যা করতে চাই।
আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গ্রাম ও শহরের মানুষ নিয়ে কাজ করেছি। বিশেষত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি– যুদ্ধ নিয়ে শহর ও গ্রামের যোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা একেবারেই আলাদা। গ্রামের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যুদ্ধ করতে গেছে, সে ঘরের মানুষকে নিজের সামনে খুন হতে দেখেছে। দেখা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সেনাবাহিনীর আশা, রাজনীতিবিদদের ভাবনা, নারীদের ইচ্ছা, গ্রাম বা শহরের মানুষের প্রত্যাশাগুলো আলাদা আলাদা ছিল। এই বিবিধতার বিষয়টি না জানার ফলে আমরা মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্লেষণকালে একই ছকে দেখি।
হামুদুর রহমান কমিশনে দেখা যায় যে, পাকিস্তান আর্মি এ ধরনের একটি আক্রমণের জন্য কোনো সময় প্রস্তুত ছিল না, কিংবা প্রতিরোধের জন্যও কখনও প্রস্তুত ছিল না। প্রতিরোধ হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান আর্মির পরিকল্পনা পাল্টে গেল, তারা পুরো বাংলাদেশ দখল করতে চেয়েছিল। তার মানে মার্চ ও এপ্রিলে যে যুদ্ধ হয়েছিল, তা ছিল সবার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে গ্রামের মানুষের, শহরের মানুষের ও মফস্বলের মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে এই বিষয়টি সামনে চলে এসেছিল যে, পাকিস্তান আর্মিকে তাড়াতে হবে, মারতে হবে, পেটাতে হবে। গ্রামে খাদ্য লুণ্ঠন হয়েছিল (যা হামুদুর রহমান কমিশনেও উল্লেখ আছে), মেয়েদের গায়ে হাত উঠেছিল– এসব কারণে তারা গ্রামের মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং এপ্রিল মাসের পরে গ্রামের মানুষকে তাদের পক্ষে পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্য হয়ে গেল। একই সঙ্গে মুজিবনগর সরকার গঠনের কাজ চলছিল। আবার সেনাবাহিনীর বাঙালি যোদ্ধারা প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল। সামগ্রিকভাবে বার্তাটা ছিল এমন: আমরা পাকিস্তানিদের তাড়াতে চাই এবং বিকল্প হিসেবে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব সেখানে আসবে।
মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে সামজিক কাঠামোরও বিশেষ বিশেষ রূপান্তর ঘটেছে। সামাজিকভাবে একাধিক শ্রেণির অবস্থান রয়েছে। এদিক থেকে বড়লোকের একাত্তর খুব সফল হয়েছে। স্বাধীনতার পরে সমাজের তিন শ্রেণির মধ্যে বড়লোকদের অবস্থান খুব ভালো হয়েছিল, আর মধ্যবিত্ত শ্রেণি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কারণ, মধ্যবিত্ত শ্রেণির নিজস্ব অর্থনীতি কখনও থাকে না। এটা মধ্যস্থতাকারী (ইন্টারমিডিয়ারি) একটি শ্রেণি। সমাজের দুটি শ্রেণির মধ্যে অবস্থান করে সরকার বা রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের সংগ্রাম করতে হয়। যেমন সাংসদরা একজন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখেন। সেই দিক থেকে তারা দুর্বল। কিন্তু শ্রেণি হিসেবে সবলীকরণ হয়েছে সাধারণ মানুষের। আজকের গ্রামে গেলে স্পষ্ট দেখা যায় যে, সেখানে নব্য নব্য শ্রেণি চলে আসছে, যে অর্থে তারা রাষ্ট্র বা শহর থেকে মুক্ত। গ্রাম ও শহরের অর্থনীতিও আলাদা। আমি একটা মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি। অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, বাংলাদেশের ১৫ মিলিয়ন লোক বিদেশে কাজ করেন। ১৫ মিলিয়নের সঙ্গে যদি আমরা প্রতি পরিবারের পাঁচজন সদস্যকে যুক্ত করি তাহলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৭৫ মিলিয়ন মানুষ। এসব মানুষ বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে না– বরং তারা আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল।