বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রকে মানবাধিকার শেখাবে, বোঝাবে কীভাবে মানবাধিকার রক্ষা করতে হয় এবারের বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে আলোচিত-চমকিত ঘোষণা আমাদের মহামান্যের। সেইসঙ্গে একাত্তরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম ঘটনা গণহত্যার আজতক কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না দেওয়ায় বিশ্বমোড়লদের সমালোচনাও করেছেন তিনি। ব্যাপক করতালি পড়েছে তার এ বক্তব্যের সময়। এবার দিবসটির আগের দিনই বিশ্ব জুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও কানাডা। এক একটি দেশ ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি বা এনটিটির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয় ১৩টি দেশের ৩৭ জন ব্যক্তিকে টার্গেট করে তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
নিষেধাজ্ঞার এই দীর্ঘ তালিকায় আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মানবপাচার থেকে শুরু করে আফগানিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তি, হাইতির জনগণকে শোষণকারী গ্যাং নেতারা। রয়েছেন যুদ্ধ বা সংঘাত সম্পর্কিত যৌন সহিংসতায় জড়িতরা, জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োজিত করা ব্যক্তি এবং অন্য দেশের মানুষের ওপর নিপীড়নকারীরা। ৪৬ জন ব্যক্তি এবং এনটিটির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ব্রিটেন। তাদের সম্পদ জব্দ করা হবে। ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। এর আওতায় ব্রিটেন যাদের টার্গেট করেছে তার মধ্যে আছেন বেলারুশের বিচার বিভাগের ১৭ জন সদস্য। বাধ্যতামূলকভাবে নারীদের হিজাব পরার আইন চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগে ইরানের ৫ জনের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। ব্রিটিশ নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া নিপীড়নকারী শাসকগোষ্ঠী এবং অপরাধীদের তারা সহ্য করবেন না। অন্যদিকে কম্বোডিয়া, লাওস ও মিয়ানমারের মানুষ পাচারের কারণে ৯ জনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। চেচনিয়াতে এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের অধিকার লঙ্ঘনের দায়ে রাশিয়ার চার ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে কানাডা। একই সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের ওপরও এমন নিষেধাজ্ঞা আসবে বলে গুঞ্জন ছিল। গুঞ্জনের আয়োজকদের প্রচারণা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের এ স্যাংশন-রেস্ট্রিকশন তালিকায় সরকারের বা সরকারি ঘরানার কয়েকজনের নামও থাকবে। এ সংক্রান্ত গুজবের হাট জমিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশে। স্যোশাল মিডিয়ায় বয়ে যায় ঝড়। ইউটিউবে পড়ে কনটেন্ট তৈরির ধুম। বিরোধী মহল বিএনপিতে এ নিয়ে উচ্ছ্বাসের পারদ ওঠে তুঙ্গেরও তুঙ্গে। শেষ পর্যন্ত এ ধরনের কিছু হয়নি। এবার মানবাধিকার দিবসে রাজধানীতে সমাবেশের উদ্যোগ নিয়ে পরে থেমে যায় ক্ষমতাসীনরা। দল থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের অনুমতি না মেলায় সে সমাবেশ হচ্ছে না। দিনটি বিএনপির খুব প্রিয়। তারা সেদিন মানবন্ধনের কর্মসূচি দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে এলিট ফোর্স র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এই নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল। চট্টগ্রামের কক্সবাজারে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ক্রসফায়ারের ঘটনার সূত্র ধরে তৎকালীন র্যাবের মহাপরিচালকসহ বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ওই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছেন সেই সময় র্যাবের মহাপরিচালক এবং বর্তমান পুলিশের আইজিও। এবার যখন বাংলাদেশ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে এবং যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে অত্যন্ত সোচ্চার অবস্থানে রয়েছে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে কী ধরনের প্রতিবেদন দেয়, তা নিয়ে জনমনে আগ্রহ-জিজ্ঞাসা একটু বেশিই ছিল। এ সুযোগে গুজববাজরা বাজারটাও বেশ জমিয়ে তোলে। নির্বাচনের আগে ১০ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির প্রতি ইঙ্গিত করে কন্টেন্ট তৈরির একটা মৌসুম জমিয়ে তোলে। সেইসঙ্গে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা জারি তো একশতে একশ করে ফেলা হয়। সরকার এসব নিয়ে কেয়ার করে না বলে জানিয়ে দিয়েছে আগেভাগেই। বরং নির্বাচন বয়কট ও ঠেকানোর হুঙ্কারে বিএনপিই এর শিকার হতে পারে বলে দাবি করতে থাকে সরকার।