১৩ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন দেশটির ২০১০-১৬ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী ৫৭ বছর বয়সী ডেভিড উইলিয়াম ডোনাল্ড ক্যামেরন। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) থাকা বা না থাকার প্রশ্নে অনুষ্ঠিত গণভোটে ব্রেক্সিটপন্থী মতামত, অর্থাৎ ইইউতে থাকার অভিমত জয়লাভ করলে ক্যামেরন ২০১৬ সালের জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ রক্ষণশীল দলের সাম্প্রতিক সময়ের অন্য প্রধানমন্ত্রী ও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে ক্যামেরনের সঙ্গেই ইসরায়েলের পাশাপাশি সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু দেশের বিশেষ সুসম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয়। সেই সুসম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনে বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে মনে করেই হয়তো প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক তাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা ও পারঙ্গমতার ওপর ক্যামেরনের নিজের যথেষ্ট আস্থা রয়েছে বলেই হয়তো তিনিও সেই দায়িত্ব নিতে বিন্দুমাত্র কোনো সংকোচ বোধ করেননি; বরং সানন্দ্যচিত্তে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা গ্রহণ করেছেন। তাঁর এই নিঃসংকোচ দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে ধারণা করা যায়, ঋষি সুনাকের নেতৃত্বাধীন দেশটির বর্তমান সরকার চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদি ইস্যু মোকাবিলায় কিছুটা হলেও বাড়তি শক্তি ও আস্থা খুঁজে পাবে।
একসময় ক্যামেরনই ছিলেন ঋষি সুনাকের দলীয় নেতা। তো সেই নেতাই যখন তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন, তখন সে বিষয়টি সাধারণের মাঝে যথেষ্টই কৌতূহল জাগায় বৈকি! আর সেই কৌতূহল যতটা না তাঁর দেশের ভেতরে তৈরি হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি জাগে দূরদেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো সমাজে, যেখানে ক্ষমতার লিপ্সায় রাজনীতিকদের প্রায় উন্মাদের মতো কিংবা সার্কাসের ভাঁড়ের মতো আচরণ করতে দেখা যায়। যতটুকু ধারণা করা যায়, ক্যামেরন তাঁর এই নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনের আশায়। শেষ পর্যন্ত তিনি তা কতটা পারবেন বা আদৌ পারবেন কি না, আমরা এর কিছুই জানি না। কিন্তু বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে বা প্রয়োজনে পদাবস্থান ভুলে গিয়ে নিবেদিতচিত্ত হয়ে দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে তাঁর এই যে আগ্রহ, সেটাই বস্তুত একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের মূল বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে তাঁকে পরিমাপের মানদণ্ড হিসেবে কোনোভাবেই শুধু তাঁর সাফল্য বা ব্যর্থতাকে গণ্য করা ঠিক হবে না; বরং তাঁর ইচ্ছার ধরন এবং এ কাজে তাঁর নিবেদনের গভীরতাই হওয়া উচিত মূল্যায়নের মূল মাপকাঠি।
প্রশ্ন হচ্ছে, ক্যামেরন যা করলেন এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের তুলনা করলে বিষয়টি কী দাঁড়ায়? জবাবে বলব, ক্যামেরনের কাছে দেশের হয়ে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনই যেখানে মুখ্য, সেখানে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের কাছে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা বা হৃত ক্ষমতা পুনরুদ্ধারই হচ্ছে মূল বিবেচনা। এর একটি কারণ অবশ্যই সামাজিক সংস্কৃতির মধ্যকার পার্থক্য। তবে এটিই একমাত্র কারণ বলে মনে হয় না। ৫২ বছর আগে এই সমাজের মূলধারার মানুষেরাই ক্ষমতার লোভ, ব্যক্তিস্বার্থ ও সব রকমের মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এমনকি আজ যাঁরা জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে কিংবা ক্ষমতায় আরোহণ করতে চান, তাঁদের পূর্বসূরিরা ১৯৭১ সালে অভিন্ন ঐক্যের অংশীদার ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, একাত্তরের ঐক্যের অংশীদারদের আজকের উত্তরসূরিদের মধ্যে সেই সব বৈশিষ্ট্যের প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই।