এ মুহূর্তে দেশের এবং অর্থনীতির এক নম্বর শত্রু কে? নিশ্চিতভাবে এর উত্তর হবে ‘মূল্যস্ফীতি’ (ইনফ্লেশন)। সাধারণ মূল্যস্ফীতি তো বটেই, সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি, যা এ মুহূর্তে ১২ শতাংশের ওপরে। ১৮ নভেম্বরের একটি খবরের শিরোনাম: ‘সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে চাল আটা ময়দা সয়াবিন রসুন ও চিনির’। আতঙ্কের এ খবরের পাশাপাশি আরেক খবর একই দিনের। ওই খবরের শিরোনাম—‘ঘূর্ণিঝড় মিধিলি: ক্ষতির মুখে বোরোর বীজতলা, আমন ধান ও শীতকালীন সবজি’। খবরটি ছিল বণিক বার্তার। দুই সংবাদমাধ্যমের খবরের শিরোনাম থেকে আমরা কী অনুধাবন করতে পারি? বোঝা যায় মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিতে আমরা আছি এবং থাকব। অথচ দেশবাসীর কামনা, সরকারের করণীয় মূল্যস্ফীতি কমানো।
মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের শত্রু, গরিবের শত্রু, অর্থনীতির শত্রু, উন্নয়নের শত্রু এবং বিপরীতে দারিদ্র্যের বন্ধু—কারণ মূল্যস্ফীতি দারিদ্র্য বাড়ায়। এ মূল্যস্ফীতি বহুল আলোচিত বিষয়। এর সঙ্গে সঙ্গেই আলোচনার আরো বিষয় হচ্ছে ডলারের মূল্য, রিজার্ভ সংকট, কম রাজস্ব আহরণ, রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস, রফতানি হ্রাস ইত্যাদি। বস্তুত আলোচনার বিষয়বস্তু এখন অর্থনৈতিক শ্লথগতি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে হরতাল-অবরোধ। জাতীয় নির্বাচন। এসব আমার আলোচনার বিষয় নয়। আমার প্রাধান্যের বিষয় হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। কী করে তা কমানো যায়। এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদের অনেক সুপারিশ আছে। পাশাপাশি ডলারের দাম এবং রিজার্ভ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও তাদের অনেক সুপারিশ আছে। মূল্যস্ফীতি রোধে তাদের সুপারিশ বোধগম্য। কিন্তু যখন ডলারের দামের ওপর তাদের সুপারিশের সঙ্গে মূল্যস্ফীতি রোধের সুপারিশগুলো মিলিয়ে দেখি, তখন আর কিছুই বুঝি না। আমার কাছে তো দুটো পরস্পরবিরোধী মনে হয়। পরস্পর সাংঘর্ষিক।
ডলারের মূল্যের বিষয়টি খোলাবাজারের কাছে ছেড়ে দিলে মূল্যস্ফীতি রোধ হবে কীভাবে? বিষয়টি বোঝার দরকার। এ অল্প কিছুদিন আগে ডলারের দাম ছিল ৮৬-৮৮ টাকা। এরই মধ্যে এর দাম ৩০ শতাংশের ওপরে বেড়েছে। বাজারে, খোলাবাজারে এর দাম উঠেছে অবশ্য ১২০ টাকায়, ১২২ টাকায়। এর ফল কী? ফল তো ভয়ংকর। এর আনুষঙ্গিক হিসেবে সরকার তেলের দাম বাড়ায়, ভর্তুকি কমায়। প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে যায়। কারণ সহজ। কারণ আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। যে তৈরি পোশাকের রফতানির পরিমাণ নিয়ে আমরা গর্ব করি, তার বিপরীতে আমদানির পরিমাণ কত বেশি! এর ভ্যালু অ্যাডিশন কম। মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, ভোগ্যপণ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এমনকি চাল, ডাল, চিনি, গম, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচামরিচ, আদা, ডিম, আলু পর্যন্ত আমরা আমদানি করি এবং তা স্বাধীনতার ৫২-৫৩ বছর পরেও। এমন সার্বগ্রাসী আমদানিনির্ভর দেশে ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে এর ফল কী দাঁড়াবে? অথচ দেশের তাবৎ অর্থনীতিবিদ এর পক্ষে। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অতীতে ডলারের দাম অহেতুক নিয়ন্ত্রিত রেখে, ‘ওভার ভ্যালুড’ রেখে, দেশের ক্ষতি করেছে। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক তা না করে দেশের ক্ষতি করেছে।
এখন ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের’ লোনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ধীরে ধীরে ডলারের দাম বাড়াচ্ছে। নির্বাচন সামনে তাই ধীরে চলছে। কিন্তু টাকার অবমূল্যায়নের গতি অর্থাৎ ডলারের বাজারভিত্তিক মূল্যায়ন আগামী দিনে ত্বরান্বিত হবে। ৮৬-৮৮ টাকার ডলারের মূল্য হয়েছে ১২০-১২২ টাকা। তাও ডলার পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার জোগান দিতে দিতে, প্রয়োজনীয় আমদানি ‘ফাইন্যান্স’ করতে করতে এখন আমাদের রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। রেমিট্যান্স ও রফতানি, বৈদেশিক সাহায্য-ঋণ, পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট ইত্যাদি না বাড়লে রিজার্ভ বাড়ার সম্ভাবনা নেই। নেই ডলারের জোগান বৃদ্ধির সম্ভাবনা। অতএব চাহিদার চাপে ডলারের দাম বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্য সমন্বয় নীতির কারণে ডলারের দাম বাড়তে থাকবে। যাক এতে আমাদের অর্থনীতিবিদদের প্রত্যাশা পূরণ হবে। কিন্তু প্রশ্ন মূল্যস্ফীতি কমবে কীভাবে? এ প্রশ্ন করতে হয় কারণ তারা দুটোই চান। ডলারের দাম বাজারভিত্তিক চান, আবার মূল্যস্ফীতিও কমাতে চান। ডলারের দাম বাড়তে থাকলে আমদানীকৃত পণ্যের দাম কমবে কীভাবে? আর আমদানীকৃত পণ্যের দাম বাড়লে দেশীয় পণ্যের দাম কি নিচের দিকে স্থির থাকবে? সহানুভূতিপূর্ণ মূল্যবৃদ্ধি (সিমপেথি রাইজ) কি হবে না? এ ধন্দে পড়ে আমি বিভ্রান্ত। কীভাবে মূল্যস্ফীতি কমবে। সোনার পাথর বাটি আর কী?