সম্প্রতি একটি অসাধারণ বই আমার চিন্তার জগতে বড় ধরনের অভিজ্ঞতা দিয়েছে। এ রকম একটি অভিজ্ঞতা পেয়েছিলাম বিনয় ঘোষের বাদশাহী আমল বইয়ে। বাদশাহী আমল মূলত মুঘল আমলে আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত চিকিৎসক লুই বার্নিয়ের কিছু চিঠিকে নিয়ে রচিত। ভারতবর্ষে অবস্থানকালে ফরাসি দেশের অর্থমন্ত্রী লিখেছিলেন। এই লেখায় মুঘলদের চরিত্র, আওরঙ্গজেবের শাসনকাল এসবই ব্যাখ্যা করেছিলেন লেখক। সময়টা সপ্তদশ শতাব্দীর। আর যে বইটির কথা বলছি সেটি তারপরের অর্ধশতক নিয়ে রচিত, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ পলাশীর এক ইংরেজ সৈনিকের কাহিনি। মেজর জন করনেইলি নামে একজন সৈনিক ভারতবর্ষে আসেন পলাশী যুদ্ধের কিছু আগে। তার ভারত আগমন, পলাশীর যুদ্ধ এবং বঙ্গদেশের মানুষ ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে রচিত। এখানেও সেই চিঠিপত্র।
জন করনেইলি তার পিতার কাছে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে চিঠিগুলো লিখেছেন। লেখক সেই চিঠিগুলোকে ব্যাখ্যা করে একটি বই রচনা করেছেন। জন করনেইলি বঙ্গদেশের শাসনব্যবস্থা, সমাজ এবং ইংরেজদের যুদ্ধকৌশল বিশেষ করে রবার্ট ক্লাইভের চরিত্রটি অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। বইটির ভূমিকায় সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বলেছেন মধ্যযুগের বাঙালির ইতিহাসে যে দুটি ঘটনা যুগসন্ধির প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭ সাল) তার একটি। অন্যটি ত্রয়োদশ শতকে ইখতিয়ার উদ্দিনের বঙ্গ বিজয়। মুষ্টিমেয় কিছু সৈনিক নিয়ে বঙ্গ বিজয়ের কাহিনি যার মধ্যে এ দেশীয় ধনকুবের, সেনাপতি, মন্ত্রীরা রয়েছেন এবং নানা ধরনের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে বিপর্যস্ত করে বঙ্গদেশকে বিদেশিদের হাতে তুলে দিয়েছেন। যদিও দুটির প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বইটিতে অনেক ঘটনা সন্নিবেশিত হয়েছে, যার মধ্যে বেশ কিছু আমাদের জানা। কিন্তু জন করনেইলি যেভাবে তা বিবৃত করেছেন তা এক চাক্ষুষ বিবরণ। বইটি পড়ে মনে হচ্ছে, এ যেন নিছক ইতিহাস নয়, এক জীবন্ত বর্ণনা এবং লেখকের কুশলী ভাষায় আমরা একটি ভ্রমণ সম্পূর্ণ করে যাচ্ছি।
কতগুলোর বিষয় গভীরভাবে দাগ কাটে। যেমন লর্ড ক্লাইভ মাদ্রাজ থেকে বঙ্গদেশে এসে এত সহজে কী করে এ দেশের শাসক এবং রাজন্যদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্যটি দ্রুত বুঝে ফেললেন। রাষ্ট্র, দেশপ্রেম এসব কিছুই যে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে নয়, এটির বারবার প্রমাণ মেলে। লোভী ও লুটেরা ইংরেজরা নবাব সিরাজউদদৌলার বাহিনীর চেয়ে অনেক কম যুদ্ধসামগ্রী ও সৈনিক নিয়ে দেশটি দখল করে ফেলে। তাদের চরিত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন মুর্শিদাবাদের কোষাগার থেকে লুণ্ঠন শুরু করে। লুণ্ঠনের শুরুতেই নতুন নবাবের প্রতিশ্রুত অর্ধেক অর্থ নেই। তদুপরি এই অর্থের প্রথম ভাগিদার হন কলকাতার কোম্পানির বড় কর্তারা, যারা কোনো যুদ্ধ করেননি, এর ফলে সেনাদের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয়।
নতুন নবাব অ্যাডমিরাল ওয়াটসন, কর্নেল ক্লাইভ ও গভর্নর ড্রেকের সঙ্গে এক চুক্তির বলে বাংলা-বিহার-ওড়িশার সব ফরাসি কুঠি ও বাণিজ্য ইংরেজদের দান করেন। এ ছাড়া যুদ্ধ ও বাণিজ্যে ক্ষতির জন্য কোম্পানিকে এক কোটি রুপি, কলকাতার ইংরেজদের পঞ্চাশ লাখ রুপি, স্থানীয় বণিকদের বিশ লাখ রুপি ও আর্মেনীয় রায়েতদের সাত লাখ রুপি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। করনেইলির হিসাবে সে সময়ের এক রুপির মূল্যমান দুই শিলিং ছয় পেনস। নৌবাহিনী ও সেনাদের জন্য যে পঞ্চাশ লাখ রুপি পাওয়া যাবে বর্তমানে তার অর্ধেক পাওয়া যাবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।