রানা দাশগুপ্ত। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘু কমিশন গঠন ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়নের অঙ্গীকার করলেও মেয়াদ প্রায় শেষ হলেও এর কোনোটি পূরণ হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সমস্যা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এই নেতা। আলোচনায় এসেছে আগামী জাতীয় নির্বাচনও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মনোজ দে
প্রথম আলো: মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলার সম্ভাবনা তো অনেক বেশিই ছিল?
রানা দাশগুপ্ত: পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রশক্তি ছিল সাম্প্রদায়িক। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনা তৈরি হয়। চুয়ান্নর নির্বাচনটি হয়েছিল পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে। তখন সংখ্যালঘুদের জন্য সংসদে আসন ছিল ৭১টি। ১৯৫৭ সালে যুক্ত নির্বাচনের বিল পাস হয়। বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈরিতার বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার উন্মেষ হতে থাকে। ষাটের দশকে এ ধারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে। সত্তরের নির্বাচন হয়ে একাত্তরে স্বাধীনতা আসে। কিন্তু বাহাত্তরের পর কী দেখলাম? মাওলানা ভাসানী ভারতবিরোধী রাজনীতি শুরু করলেন। জাসদের রাজনীতির মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর লোকজন ঢুকে পড়ল। ৭ নভেম্বর যে লিফলেট প্রচার করা হলো, তাতে পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি সামনে আনা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে ভারতবিরোধী ও হিন্দুবিরোধী স্লোগান উঠল, সেটি কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দেয়নি।
যারা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছে, তাদের অনেকে দিয়েছে। অর্থাৎ আমাদের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনাটি ছিল অসম্পূর্ণ ও ভঙ্গুর। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের আশাভঙ্গের শুরু স্বাধীনতার পর থেকেই। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর চার মূলনীতি নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়েছে, তার আগের মাসে অক্টোবরে শারদীয় দুর্গাপূজায় পূজামণ্ডপে হামলা হয়। হামলাকারীরা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়েছে। সেদিনের সরকার ও প্রশাসন এর বিপদ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর পঁচাত্তরের পর তো সংবিধানই বদলে দেওয়া হলো। জিয়াউর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিলেন, এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন থেকে আমরা রাষ্ট্রীয় সংখ্যালঘুতে পরিণত হলাম।
প্রথম আলো: আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আপনাদের শঙ্কা ও প্রত্যাশা কী?
রানা দাশগুপ্ত: আশাও করছি, শঙ্কাও আছে। আশা হচ্ছে, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, জনগণ অবাধভাবে সেই নির্বাচনে ভোট দিতে পারুক। সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল একত্র হয়ে গণতন্ত্র সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে কাজ করুক। এবার আশঙ্কার কথাটা বলি। এবারে জন্মাষ্টমীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, একটা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হতে পারে, আপনারা সবাই সজাগ, সতর্ক থাকবেন। এর চার দিন পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বললেন, সামনে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হতে পারে এবং বিএনপির বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। দেখা যাচ্ছে, দুই পক্ষেরই শঙ্কা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদও ছয় থেকে সাত মাস আগে থেকেই বলে আসছে, সামনের দুর্গাপূজা ও নির্বাচনের আগে-পরের সময়টাতে আমাদের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কিত। আমাদের সেই শঙ্কা কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোও স্বীকার করে নিল। আমরা মনে করি, নির্বাচনের পরে কিংবা আগে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা যাতে না হয়, সে বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন।
প্রথম আলো: বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের ঐকমত্য হবে বলে কি আশা করেন?
রানা দাশগুপ্ত: আমরা সব সময় আশা করতে চাই। আবার নিরাশ হতেও খুব বেশি সময় লাগে না। ২০২১ সালের দুর্গাপূজার সময় ৩২টি জেলায় সহিংসতা হয়েছে। কিন্তু ২০২২ সালে আমরা সেটা দেখিনি। আমাদের মনে হয়েছে, প্রশাসন সচেষ্ট ছিল বলেই সহিংসতা হয়নি। কিন্তু এবার এ পর্যন্ত আট থেকে নয়টি জায়গায় বিগ্রহ ভাঙচুর হয়েছে। একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার সম্পর্কে পুলিশ বলেছে, সে পাগল। ২০২১ সালেও আমরা দেখেছিলাম কুমিল্লার ঘটনায় ইকবালকে যখন ধরা হলো, বলা হলো সে পাগল।