কবি আবুল হাসান লিখেছেন– ‘ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও!’ নীরবতা ভারী পর্দার মতো আড়াল করে রাখে আমাদের। কিন্তু নীরবতারও সীমা-পরিসীমা আছে। কতক্ষণ, কতদূর নীরব থাকা যায়? বাংলাদেশে অনেক জায়গায় তলানির লোকজন মঞ্চ দখল করছে। মঞ্চে লোকজন বেশি হওয়ায় তা ভেঙে পড়ছে। অযোগ্যরা মিলে যোগ্যদের নাজেহাল করছে। এর কারণ কী? এর একটি বড় কারণ ভালো মানুষের মধ্যে ‘অনৈক্য’! যার সুযোগে ঘটছে ‘মন্দদের ঐক্যবদ্ধতা’।
তাহলে এই দুর্বিষহ অবস্থায় সান্ত্বনা কী? সান্ত্বনা হলো, প্রতিপক্ষের প্রতিটি আঘাতকেই আপনার কাঙ্ক্ষিত সম্মান হিসেবে ভাবা যেতে পারে। বাংলাদেশের সিনেমাশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের নেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের কথা মনে আছে কি আমাদের? ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করেছেন। তিনি একাই গড়ে তোলেন নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন নামের একটি সংগঠন। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে বিভিন্ন মহলের নানামুখী হুমকির সম্মুখীন হলেও তিনি লড়েছেন সাধ্যমতো। ২০১৮ সালে ঢাকায় দু’জন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে তুমুল আন্দোলন হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইন পাস হয়। রুপালি পর্দার ইলিয়াস কাঞ্চন সবার চোখের পর্দায় সত্যিকারের হিরো হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে আক্রোশ ফুটে উঠেছিল পরিবহন মাফিয়াদের। সেদিন সারাদেশের পথঘাটে পরিবহন মাফিয়ারা ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে জুতার মালা ঝুলিয়ে রেখেছিল। এর চেয়ে ‘বড় সম্মান’ আর কী হতে পারে! সেই প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই আমরা বিস্মৃত হইনি।
মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন বলে কি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ থেমে ছিল? ইলিয়াস কাঞ্চনের এই সক্রিয়তা বাংলাদেশে চলমান ভয়ের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ওয়ান ম্যান আর্মির একনলা বন্দুক! রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ লিখেছিলেন– ‘বাংলাদেশে এমন এক সময় আসবে, যেখানে ব্যক্তির সক্রিয়তাই নির্ধারণ করবে ভয়ের সংস্কৃতির প্রাবল্য।’ আলী রীয়াজের ভয়ের সংস্কৃতি এক অর্থে ‘অব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী’। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কিছু চরিত্র লক্ষণ দেখে তিনি মনে করেছিলেন, দেশ ক্রমাগত ভয়তাড়িত একটি জনপদে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। বইটির প্রাথমিক ভাষ্যের ১০টি অনুমান ও বিশ্লেষণ দশ বছর না যেতেই দিবালোকের মতো দৃশ্যমান হলো। তার আরও দশ বছর পর সবাই স্বীকার করতে থাকলাম বইয়ের মূলভাবটি আরও দৃশ্যমান– বাংলাদেশ এখন ভয়ের সংস্কৃতি দ্বারা তাড়িত। ভয়ের সংস্কৃতি বইতে আমরা পাই– ‘বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা এক প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। একথা মোটেই অতিরঞ্জন নয় যে, বাংলাদেশ অসহিষ্ণুতার এক গভীর গহ্বরে পতিত হয়েছে এবং শক্তি প্রয়োগের ঘটনাবলির মাধ্যমে সেই অসহিষ্ণুতা তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।’