রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮২তম প্রয়াণ তিথিতে এসে অনুভব করছি, কবিগুরু যে সারা জীবন শাশ্বত সুন্দরের প্রতীক্ষায় এত বিশাল সাহিত্যসম্ভার সৃষ্টি করে গেলেন, তার কতটুকুই বা আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছি? বরং সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে তাঁর জীবিতকালে এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও রাজনীতি কম হয়নি। তিনি যেমন অধিকাংশ মানুষের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র, তেমনি ধর্মান্ধ, প্রগতির শত্রুদের চক্ষুঃশূল হয়েছেন বহুবার।
রবীন্দ্রবিরোধিতাকে মোটামুটি তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে:
ক. কবির জীবদ্দশায় তাঁর সাহিত্য, সংগীত ও শিল্পকর্মের বিরোধিতা; খ. পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রবীন্দ্রবিরোধিতা; গ. স্বাধীন বাংলাদেশে রবীন্দ্রবিরোধিতা।
ক. রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতেই তাঁর সাহিত্য ও সংগীত নিয়ে একটি পক্ষ বিরোধিতা করে গেছে। যদিও তা একটি নির্দিষ্ট গঠনমূলক ধারায় ছিল। ত্রিশের কবিরা বা কল্লোল পত্রিকা (১৯২৩-২৯) রবীন্দ্র সাহিত্যকে বিরোধিতা করেই মূলত গড়ে উঠেছিল। কল্লোলের একদল লেখক রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজেদের কথা নিজেদের মতো করে বলতে চেয়েছিলেন এ কথা ঠিক। কিন্তু এই পত্রিকা কবিকে কখনো অশ্রদ্ধা বা অবজ্ঞা করেনি।
খ. দেশভাগের পর পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রবিরোধিতাকে ইন্ধন দেওয়া হয় রাজনৈতিক কারণে, যার মূল চালিকা শক্তি ছিল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। তা শুরু হয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। রবীন্দ্রনাথকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা চললেও পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজ বুঝতে পারল, তারা নিজ দেশে পরবাসী। মাতৃভাষা বাংলার ওপর আঘাত এলে মুসলমান মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের বোধোদয় হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতাসীন হয়েই বুঝতে পারলেন পূর্ব পাকিস্তানের এই ভূখণ্ডকে ইসলামি আদর্শের পাকিস্তানের সঙ্গে ধরে রাখতে হলে তথাকথিত হিন্দু কবি-সাহিত্যিক, সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ থেকে এ দেশের জনগণকে দূরে রাখতে হবে। তাই ১৯৫৯ সালের গোড়ার দিকে আইয়ুব খানের কঠোর সামরিক শাসনের আওতায় পাকিস্তানের করাচিতে এক লেখক সম্মেলন হয়। সেখানে আইয়ুব খান ঘোষণা দেন পাকিস্তানি ভাবাদর্শের প্রতি লেখকদের আনুগত্য থাকতে হবে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, রবীন্দ্রনাথ, বাঙালিত্ব এগুলোর চর্চা পাকিস্তান চেতনার পরিপন্থী হিসেবে গণ্য এবং কঠোর হস্তে তা দমন করা হবে। তাঁর এই ঘোষণাকে মুক্তকচ্ছ সমর্থন জানায়, প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী, বাঙালিবিদ্বেষী মহল। এই রবীন্দ্রবিদ্বেষী আবহাওয়ার মধ্যেই চলে এল পঁচিশে বৈশাখ, ১৯৬১, বিশ্বকবির জন্মশতবার্ষিকী। পাকিস্তানি শাসক ও অনুচরেরা উঠেপড়ে লাগলেন পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে যেন এই ভারতীয় ‘হিন্দু’ কবির জন্মশতবার্ষিকী পালিত হতে না পারে। প্রগতিশীল, মুক্তবুদ্ধির পক্ষের লোকজনও বদ্ধপরিকর রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালনে। আইয়ুব ও মোনায়েম খানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী সফলভাবে পালন করা হয়। ১৯৬৩ সালে অলিখিত আদেশে ঢাকা বেতার, ও প্রকাশ্যে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। সফল রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের পর একটি অংশ বাঙালি সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথকে বাঁচিয়ে রাখতে ছায়ানট প্রতিষ্ঠা করে।
১৯৬৭ সালের ২১ জুন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ঢাকা নবাব পরিবারের খাজা শাহাবুদ্দিন আনুষ্ঠানিক ফরমান জারি করলেন, পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী রবীন্দ্রনাথের গান প্রচার করা হবে না। ২৪ জুন ১৯ জন অকুতোভয় বুদ্ধিজীবী এই ফরমান প্রত্যাখ্যান ও বিরোধিতা করে বিবৃতি দেন। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এবং ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দেন, এই বাংলায় রবীন্দ্রনাথকে কেউ নিষিদ্ধ করতে পারবে না।