জন্মেছিলেন জমিদার ঘরে। জমিদার বাবা ছিলেন একজন সাক্ষাৎ ঋষি। যিনি জীবনের মানে খুঁজেছেন শিক্ষা, সঙ্গীত আর মানবকল্যাণে। নিজের ধনদৌলত অকাতরে অভাবী নিপীড়িত মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। এমনকি ঘোষণা দিয়ে স্ত্রীর গয়নাগাটি গ্রামের সমবেত দরিদ্র মানুষদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এরকম সহায়সম্পত্তির প্রতি নির্লোভ ক্ষ্যাপাটে মানুষটির এহেন প্রবণতায় তার স্ত্রীর সমর্থন ছিল ঠিক ঠিক।
পান্না কায়সারের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা, তাঁর আলোচনা শোনার অভিজ্ঞতা এবং আত্মজৈবনিক রচনা পাঠ থেকে যতটা জেনেছি, ওই সময় তাদের পরিবার এবং এলাকার রেওয়াজ ছিল মেয়েরা কেবল প্রাথমিকের গণ্ডি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারবে। প্রাথমিকের পর বিদ্যালয়ে যাওয়া বারণ। তিনি বাড়িতেই মেয়েদের শিক্ষার বন্দোবস্ত করেছেন। স্কুলের শিক্ষকগণ জমিদার বাড়িতে এসে জমিদার কন্যাদের পড়িয়ে যেতেন। এতেও আত্মীয়স্বজন আর গ্রামবাসীদের রোষ থেকে রেহাই পাননি। তারা মেয়েদের দেখলে টিপ্পনি কেটে নানা অবজ্ঞাসূচক কথাবার্তা বলত। হিন্দু বনে যাবার রটনা করত। এমন ঋষিতুল্য মানুষটি বংশের পরলোকগত মানুষদের কবরের কাছে গিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতেন। এতে আত্মীয় প্রতিবেশীরা তার দিকে তেড়ে আসত। তিনি তাতে দমে যেতেন না। তিনি বলতেন, “পূর্বপুরুষরা তো সবসময় দোআ-দরূদ শোনেন। মাঝে মাঝে গান শুনলে ওঁদের মনটা ভালো থাকব। ওঁরা আনন্দ পাবেন।”
এই ঋষি মানুষটি রাতে ঘুমাতে যাবার আগে তার সন্তানদের নিয়ে একসঙ্গে গান করতেন। ওই আসরে তার স্ত্রীও এসে যোগ দিতেন। রাতের বেলায় কখনো মেয়েকে বলতেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাতে। আর তিনি বাইরে পুকুরঘাঁটে বসে মেয়ের বাঁশি বাজানোর সুরে সুরে জীবনের 'সুন্দর' উদযাপনে নিমগ্ন থাকতেন।
তার মেয়েদের দূরের মহাবিদ্যালয়ে হোস্টেলে রেখে পড়িয়েছেন। এরকম দাতা হাতেম তাই স্বভাবের কারণে জমিদারি ক্ষয়ে যায়, আর্থিক দুর্দশা পেয়ে বসলেও মনে ভেঙে পড়েননি। সন্তানদের সাহস ও উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন ঋষিতুল্য মনীষীর মতোই। মেয়ের উচ্চমাধ্যমিক পাশের খবরে বাড়ির বাইরে আতশবাজি ফুটিয়েছেন। এতে গ্রামবাসী বিরাগভাজন হয়েছে, ভুল প্রচারণা চালিয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সেই বাবা তার এক মেয়েকে বাড়িতে পড়শোনা করিয়ে মফস্বল শহরে নিবন্ধন করে পরীক্ষার বন্দোবস্ত করেছেন। আত্মীয় ও গ্রামবাসীরা সেই কেন্দ্রের প্রধান শিক্ষক এবং থানায় গিয়ে নানা অভিযোগ করে মেয়েটির পরীক্ষা ঠেকানোর তৎপরতা চালিয়েছে। কোনো তৎপরতাই তাদের দমাতে পারেনি। না বাবাকে, না তার মেয়েকে। আর ১৯৬০-এর দশকে এভাবে সংগ্রাম করে মাধ্যমিক পাশ করা মেয়েটিই আজকের মহিয়সী নারী পান্না কায়সার।