‘রুগ্ণ ছেলের শিয়রে বসিয়া
একেলা জাগিছে মাতা,
সম্মুখে তার ঘোর কুজ্ঝটি মহাকাল
রাত পাতা।…’
কবি জসীমউদ্দীনের আমল থেকে হালের বিশ্বায়নের পল্লিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে বটে; কিন্তু তাতে একজন ‘একা মায়ের’ নিঃসঙ্গতার হাহাকার কি বিন্দুমাত্র কমেছে? সিঙ্গেল মাদার বা একা
মা তালাক নেওয়া অথবা বিধবা—দুজনই হতে পারেন; অর্থাৎ জীবনসঙ্গীবিহীন এই মা । ১৪ মে আন্তর্জাতিক মা দিবস। আমরা কি কখনো ভেবেছি, একজন একা মায়ের শরীর ও মনের কথা?
জীবনে পরিবর্তন, ডিসঅর্ডার ও কারণ
সিঙ্গেল মাদার বা একা মা যে একটি আত্মপরিচয় হতে পারে, তা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মনোসামাজিক স্বাস্থ্যসচেতনতায় আসেনি। ঢাকা সিটি করপোরেশনের উপাত্ত অনুযায়ী, ৭০ শতাংশ বিবাহবিচ্ছেদে স্ত্রী আবেদন করছেন। ২০১৮ সালে ঢাকা শহরে ডিভোর্সের হার প্রতি ঘণ্টায় একটি। প্রশ্ন হলো, ডিভোর্সের শারীরিক ও মানসিক প্রভাব কী কী?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ৫৪ শতাংশ একা মা বিষণ্নতার ভেতর দিয়ে যান, ২৪ শতাংশ দুশ্চিন্তায়, ৯ শতাংশ সামাজিক ভীতিতে আর ৬ শতাংশ বেশি মাত্রায় ডিসঅর্ডারে ভোগেন।
আবার যে মা এই সমস্যায় ভুগছেন না, তাঁদের মধ্যেও দেখা গেছে ৬৮ শতাংশ কাজের চাপ, ৬৭ শতাংশ অর্থনৈতিক চাপ এবং ৩৫ শতাংশকে সামাজিক অসম্মানের বোঝা ঘাড়ে নিতে হচ্ছে। এ গবেষণায় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে, ২১ দশমিক ২০ শতাংশ নারী সেপারেশন নিয়েছেন স্বামীর পরকীয়া, পুনর্বিবাহের কারণে; শারীরিক নির্যাতনের কারণে ৩৪ দশমিক ৬০ শতাংশ নারীর ডিভোর্স হয়েছে এবং ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ নারীর জীবনে একাকিত্বের কারণ বৈধব্য। এই একা মায়েদের মাত্র ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ গৃহবধূ, বাকি
৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ চাকরিজীবী; অর্থাৎ অর্থনৈতিক মুক্তি মাকে স্বাবলম্বী করেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত এবং স্বামী থেকে আলাদা থাকেন এ রকম নারীর
সংখ্যা ৯ দশমিক ১ শতাংশ হলেও ২০১৮ সালে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৮ শতাংশে। কিন্তু করোনা অতিমারি-পরবর্তী সময়ে এই সংখ্যা আকাশচুম্বী হয়েছে।
মেনোপজের পর শরীর ও মন
মেনোপজের পর মায়েদের শরীর ও মনে প্রভাব পড়ে। কারণ, সম্পূর্ণ বিষয়টি হলো হরমোনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটি রিপ্রোডাকটিভ এইজের (প্রজনন বয়স) মেয়ের রূপ, গুণ, চাকচিক্য—সবকিছু হরমোনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই হরমোন যখন শরীর থেকে হঠাৎ চলে যায় অথবা ধীরে ধীরে চলে যাওয়ার সময় হয়, তখন শরীরে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। এগুলোর মধ্যে আছে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, কোনো কিছু ভালো না লাগা, হঠাৎ করে কান ও মাথা গরম হয়ে যাওয়া, হাত-পায়ের তালু জ্বলা, ঘাম হওয়া।
এ সময় নিজের শরীরের যত্ন নেওয়া বেশি প্রয়োজন। একা মাকে মনে রাখতে হবে, তিনি এবং সন্তান—দুটো বিচ্ছিন্ন সত্তা। সন্তানকে উজাড় করে সব দিতে গিয়ে তিনি কি নিজেকে বঞ্চিত করছেন? মনে রাখতে হবে, নিজের যত্ন নেওয়া মানে স্বার্থপরতা নয়।
পুষ্টির ঘাটতি
আমাদের দেশে মায়েদের পুষ্টির ঘাটতি ঐতিহাসিক ঘটনা। তাঁদের জন্য সুষম খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। উপরন্তু দেশে বর্তমানে যে ধরনের পরিবেশদূষণ ও তাপমাত্রা বাড়ছে, তাতে দৈহিক বাড়তি যত্নের প্রয়োজন। ডাবের পানি, খাওয়ার স্যালাইন ইত্যাদি সহজলভ্য বিষয়গুলো শিশুদের খাওয়ানোর পাশাপাশি নিজেদেরও খেতে হবে।