রুচির দুর্ভিক্ষের প্রশ্নে শিল্পী সমিতির সম্মেলনে আমার বক্তব্য একটি দৈনিক পত্রিকায় পুনরুল্লেখকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একেবারে তোলপাড় চলছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে বলেছিলেন, ‘দেশে আজ রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে। তাই দুর্ভিক্ষ থাকলেও দুর্ভিক্ষের ছবি আঁকতে পারছি না।’ কথাটি আমি বলার পর এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। কিন্তু ওই দৈনিকে বিষয়টার কিছু বিশ্লেষণ দেওয়ার পরেই সামাজিক মাধ্যমে ঝড় ওঠে। অধিকাংশ পাঠক সমর্থন করে পোস্ট দিতে থাকেন, আবার বেশ কিছু পাঠক ওই পোস্টের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে থাকেন।
বিষোদ্গারের ভাষা কখনো যুক্তিহীন এবং আক্রমণ ব্যক্তিগত। ওখানে বিতর্কের কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে গেল হিরো আলম। রুচির দুর্ভিক্ষ কি একাই হিরো আলম ঘটিয়েছেন? নাকি বিপুলসংখ্যক লোকই বিষয়টির মূলে রয়েছে?
বলা হয়েছিল, দেশে এখন রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে এবং তার মধ্যে হিরো আলমের উত্থান হয়েছে। তাঁর সমর্থকেরা অত্যন্ত জোর দিয়ে তাঁর শ্রেণি অবস্থানকে টেনেছেন—তিনি গরিব, সে কারণেই তাঁর কথা বলা হয়েছে। ধনাঢ্য মাহফুজুর রহমান ও অনন্ত জলিলকে নিয়ে কেন লেখা হলো না? কেউ কেউ অত্যন্ত আপত্তিকরভাবে আমাকে নিয়ে মন্তব্য করতে ছাড়েননি। একজন সাবেক চিত্র পরিচালক বলেছেন, আমি নাকি আলোচনায় আসার জন্য এসব করছি। আমার আলোচনায় আসতে হবে কেন? আলোচনায় এলে আমার লাভই বা কী হবে?
আমি যে শিল্পে কাজ করি, সেখানে কোনো মারমার-কাটকাট নেই। ক্রিকেট, ফুটবল বা সিনেমার মতো লাখ লাখ দর্শক নিয়ে আমাদের কারবার নয়; যা কিছু করে থাকি মঞ্চে, টেলিভিশনে বা সিনেমায় তা একধরনের মননশীল উপস্থিতি; পরিশ্রম করে একটা কিছু দাঁড় করানো। এ ধরনের আলোচনা তৈরি করা যে আমার উদ্দেশ্য নয়, তা আমার সুদীর্ঘ ৫০ বছরের কর্মকাণ্ড থেকেই পরিষ্কার। তবে সম্মান পেয়েছি প্রচুর। পুরস্কার ও সম্মাননা যা পাওয়ার তা পেয়েছি। শুধু আমি নই, আমার যাঁরা সহকর্মী, ছাত্র, তাঁরাও ঢের পেয়েছেন। কেউ কেউ আমার চেয়েও অনেক বেশি পেয়েছেন। এসব ব্যাপারে কোনো ঈর্ষা কিংবা অহংকার কোথাও প্রকাশ করাকে আমি চিরকাল অন্যায় বলে মনে করেছি।
যাঁরা সামাজিক মাধ্যমে তাঁদের মুক্তচিন্তাকে প্রকাশ করেছেন, তাঁদের আক্রমণের ভাষা এত স্থূল যে বোঝা যায় তাঁরা পুরো প্রতিবেদনটি পড়েননি। যুক্তিগুলো বোঝার কোনো চেষ্টাও করেননি। আমি অনেক ধরনের বিষয়কে এনেছি, যা খুবই সম্পর্কিত। শিক্ষা, রাজনীতি এসব বিষয় তাঁদের পোস্টে আসেনি। আমরা কি একটি অত্যন্ত সুস্থ রাজনীতির মধ্যে দিনযাপন করছি? একটা যুগোপযোগী ও মননশীল শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছি? প্রতিদিন এসব বিষয়ে যেসব সংবাদ গণমাধ্যমে ছাপা হয় তা কি মনোযোগ দিয়ে পড়ি? এত ধরনের লুণ্ঠন, অর্থ পাচার, ধর্ষণের ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে, সেগুলোর বিশ্লেষণ করলে তার মধ্যে মিডিয়ার যে দায়িত্বহীনতা, তা কি প্রকাশ পায় না? আর এই দায়িত্বহীনতা কারা করছে? একা হিরো আলম করছেন কি? এখানে তিনি একটা উদাহরণ মাত্র। আর এই উদাহরণ যথার্থই। যাঁরা তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং সুরুচির পক্ষে সাফাই গাইছেন তাঁরা অনুগ্রহ করে তাঁর কাজগুলো কি কখনো দেখেছেন? আমি নিশ্চিত, তাঁরা দেখেননি। কারণ অনেকেই আমাকে বলেছেন, ‘ওর এগুলো আমরা দেখিও না, এই সব আবর্জনা নিয়ে কথাও বলি না।’ কথাটি একেবারেই ঠিক না। যাঁরা সচেতন এবং উদ্বিগ্ন নাগরিক, তাঁদের তো এসব দেখতেই হবে, আলোচনা করতেই হবে। কারণ, দেশটার উন্নতি ও অবনতির দায় তো নাগরিকদের নিতেই হবে।