গত বছর যখন দেশে ছিলাম, তখন গিয়েছিলাম ঢাকার বাইরে একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিতে। আন্তর্জাতিক ফ্যাকাল্টি সদস্য হিসেবে সেখানে আমার একটি উপস্থাপনা ছিল। তিন দিনের সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। শুরু হলো দু-ঘণ্টা দেরিতে। দু-ঘণ্টার কর্মসূচি। তবে অনুষ্ঠান যখন শেষ হলো, রাত তখন একটা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরুর বক্তৃতাপর্ব যেন আর শেষ হয় না। উদ্বোধক মন্ত্রী ঢাকায়, ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করবেন। তবুও মঞ্চভর্তি বক্তা। মঞ্চের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত সারি সারি পাতানো চেয়ারে সবাই বসা। সবাই বক্তৃতা করলেন। একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সবাইকে কেন বক্তৃতা করতে হবে? বক্তৃতার বিষয়বস্তু বিজ্ঞানসম্মত হলেও কথা ছিল। অধিকাংশ কথাবার্তা রাজনৈতিক।
বিদেশে যত বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে গিয়েছি কোথাও মঞ্চভর্তি বক্তা থাকে না। হাতে গোনা দু-চারজন বক্তব্য রাখেন। তারা নিতান্তই আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত প্রথমসারির মানুষজন। কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে বেইজিং গিয়েছিলাম একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিতে। চোখ ধাঁধানো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। যে মিলনায়তনে সম্মেলনটি উদ্বোধন হলো সেখানে একত্রে বসতে পারে তিনহাজার দর্শক-শ্রোতা। মঞ্চের কথা আর কি বলব! শ' খানেক চেয়ার বসানো যাবে ওই মঞ্চে। অথচ বক্তার জন্য কোনো চেয়ার নেই। সবাই দর্শক সারির সামনের কাতারে বসা। মঞ্চ থেকে ডাকা হচ্ছে। যাচ্ছেন। দু-তিন মিনিট কথা বলে চলে আসছেন। তাও আবার তিন-চারজনের বেশি নয়। মঞ্চ বিশাল, বক্তা কম। মঞ্চ ভেঙে পড়ার কোনো অবকাশ নেই।
দেশে ইদানীং মঞ্চ ভেঙে পড়ার আতঙ্কে আছেন নেতারা। আজকাল নেতা বাড়ছে, কর্মী কমছে, মঞ্চ ভাঙছে অহরহ। সাম্প্রতিক সময়ে মঞ্চ ভেঙে নেতাদের ধরাশায়ী হওয়ার আলোচিত ঘটনাটি ঘটেছে ছাত্রলীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। এ বছরের ৬ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘটনাটি ঘটে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বক্তব্য দিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই বিকট শব্দে মঞ্চ ভেঙে পড়ে। আহত হন ৯ নেতাকর্মী। গুরুতর আহত হন যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলি। তার পায়ে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়েছিল। আহতদের তালিকা দেখলে বুঝতে পারবেন, ওই মঞ্চে তাদের সবার কি থাকার দরকার ছিল? সবচেয়ে দৃষ্টিকটু লেগেছে একটি ছবিতে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে সত্যিকারের নেতাদের পাশাপাশি তথাকথিত নেতারা মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন। আর কিছু নৃত্যশিল্পী মূল মঞ্চের সামনে নেচে যাচ্ছেন। তথাকথিত নেতাদের আধিক্য মঞ্চ ভেঙে সত্যিকারের নেতাদের শুধু ধরাশায়ী করেনি, শিল্পীদেরও মঞ্চ থেকে নিচে নামিয়ে দিয়েছে।
মঞ্চ ভেঙে পড়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের উঠে দাঁড়িয়ে পুনরায় বক্তব্য শুরু করেন। আক্ষেপ করে বলেন, ‘একটু আগে মঞ্চ ভেঙে গেছে। কিন্তু নেতাদের মঞ্চে ওঠা, এত নেতা আমার দরকার নেই। আমরা কর্মী উৎপাদনের কারখানা চাই। যে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সামনের লোকের চেয়ে মঞ্চে লোক বেশি।’ মঞ্চ ভাঙার ব্যাপারে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, 'আমাদের স্টেজের গাঁথুনি যে পরিমাণ মজবুত করার কথা ছিল সেটা না করার কারণে এ ঘটনা ঘটল।' ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, 'আমরা চেষ্টা করেছি মঞ্চটি যেন যথাযথ ও মজবুত হয়। কয়েক শ’ লোকের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন মঞ্চ করেছিলাম। এরপরও এ দুর্ঘটনা দুঃখজনক।’ ছাত্রলীগের নেতাদের কেউ মঞ্চের নেতাকর্মী কমানোর ব্যাপারে কিছু বলেননি। তারা মঞ্চের গাঁথুনি মজবুতকরণে গুরুত্ব দিয়েছেন। অথচ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যিনি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক; বলেছেন, এত নেতা আমার দরকার নেই। কর্মী দরকার। তিনি প্রকারান্তরে মঞ্চে নেতা কমানোর কথা বলেছেন। আর ছাত্রলীগ ভাবছে মঞ্চ মজবুত করার কথা। সাবেক বর্তমানদের চিন্তা চেতনায় কত ফারাক?