সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এর হাত থেকে আমরা মুক্ত নই। সেই কবে ব্রিটিশ তাদের কলকাঠি নেড়ে ভারতবর্ষ বিভক্ত করে দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার স্বপ্ন পূরণের পথে হেঁটেছিল, যার ফল সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান। মুসলিম লীগ ভারত ভাগের দাবি তুলেছিল সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে। সেই থেকেই আমাদের দেশে শুরু হয়েছিল ধর্মের নামে মানুষের বিভাজন। বাংলাদেশ কখনও ধর্মীয় রাষ্ট্র ছিল না। বাংলাদেশ বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র। এখানে অধিকাংশই মুসলমান হলেও হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটি প্রভাব বিদ্যমান। আরও কিছু ক্ষুদ্র অমুসলমান জাতিসত্তার অস্তিত্ব বাংলাদেশে থাকলেও হিন্দুদের সঙ্গে তাদের একটি বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশের হিন্দুরা শাসকশ্রেণির সঙ্গে ছিল সব সময়। বর্তমান সময়ে হিন্দুদের সংখ্যা দাঁড়াবে ৮ শতাংশ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি বড় পার্থক্য বিদ্যমান। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানের সংখ্যা ৩০ শতাংশেরও ওপরে। পশ্চিমবঙ্গে তাদের চাকরির হার ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে। কারণটা হলো, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা শাসকশ্রেণির বাইরে অবস্থান করছে। আর বাংলাদেশের হিন্দুরা বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির কাছাকাছি অবস্থান করছে। এ কারণে বাংলাদেশের হিন্দুদের আর্থিক অবস্থা, শিক্ষার মান সবকিছুই তুলনামূলকভাবে উন্নত। তাদের সংখ্যা কম হওয়ায় এবং আর্থিক অবস্থা সুবিধাজনক হওয়ায় অর্থ-সম্পদের প্রতি লোভ থাকে কিছু মুসলমান জনগোষ্ঠীর। তাই সুযোগ পেলে তারা সাম্প্রদায়িক ধোঁয়া তুলে হিন্দুদের দেশত্যাগের পরিবেশ সৃষ্টি করার অপচেষ্টা করে। কিন্তু শাসকশ্রেণি যেহেতু অসাম্প্রদায়িক নীতিতে বিশ্বাসী এবং হিন্দুরা তাদের রাজনৈতিক দোসর- এমন অপচেষ্টা অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয়ে ওঠে না।
'ওঁরা অপরাধ করেছে কিনা, আমি জানি না। আমি জানি- ওঁদের কাজকর্ম অত্যন্ত ভালো; ওঁরা ব্রাহ্মণ, ওঁদের মূল্যবোধ উঁচু দরের'- এমন কথাই বলেছিলেন গুজরাটের বিজেপি বিধায়ক সিকে রাউলজি। তিনি আবার সেই বোর্ডের সদস্য, যারা ২০০২ সালের ৩ মার্চ ২১ বছর বয়সী পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানুর ওপর হওয়া দলবদ্ধ ধর্ষণ; তাঁর তিন বছরের মেয়েসহ পরিবারের সাত সদস্যকে খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত ১১ জন অপরাধীকে মুক্তি দিয়েছে সম্প্রতি। দাঙ্গাবিধ্বস্ত গুজরাটে যখন প্রথম এ মামলায় অভিযুক্তদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তখন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অনুভব করেছিলেন, যে আতঙ্ক এবং নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ রয়েছে তার মধ্যে নিরপেক্ষ ও ন্যায্য শুনানি গুজরাটে সম্ভব নয়। অতঃপর মামলাটি গুজরাট থেকে সরিয়ে মুম্বাই নেওয়া হয়। মুম্বাইয়ের বিশেষ সিবিআই আদালত এ মামলার রায় ঘোষণা করেছিলেন। ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। একজন আসামি পরবর্তী সময়ে মারা যান।
এবারের গুজরাটের সংশ্নিষ্ট কমিটি ১১ জন বিচারপ্রাপ্ত আসামির সবাইকেই মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সম্পূর্ণ নগ্নাবস্থায় পড়েছিলেন অচেতন বিলকিস। সেখান থেকে আটজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তাঁর মহল্লায় আগুন ধরিয়ে বিলকিসের অন্তত ১৪ জন আত্মীয়কে খুন করা হয়, যাঁদের মধ্যে তাঁর ৩ বছরের মেয়েও ছিল। বিলকিসকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছিল। বিলকিসের এ কাহিনি ভারতীয় গণতন্ত্রে এক চিরকালীন কলঙ্কজনক ইতিহাস হয়ে থাকবে। এবার জেল থেকে বেরিয়ে বীরের সম্মান লাভ করল ধর্ষক ও গণহত্যাকারীরা। মালা পরিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে তাদের বরণ করা হয়। যাঁরা অত্যাচারিত হয়েছেন, খুন হয়েছেন, প্রতিহিংসার তীব্রতায় নিজ দেশে বারবার পরবাসী হয়েছেন- তাঁদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু সংবর্ধনাকারীদের আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবরা? তাঁরাও নিশ্চুপ হয়ে যাবেন- তা কি মেনে নেওয়া যায়? বাকিটা জানেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। তাঁরা গুজরাট সরকারের কমিটির এ সিদ্ধান্ত মানবেন, নাকি সেই মুক্তির সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নিয়ে ওই ১১ জনকে আবার জেলে ঢোকাবেন- তার উত্তর এখনও স্পষ্ট নয়। তবুও এ সামাজিক, আইনি ও রাজনৈতিক শোরগোলের মধ্যে মৃদুভাষী বিলকিস বানুর কয়েকটা কথা বড্ড কানে বাজে- 'গত ২০ বছরের আতঙ্ক আবার আমাকে গ্রাস করল ১৫ আগস্ট; যখন আমি শুনলাম আমার জীবন ও পরিবারকে নষ্ট করে দেওয়া ১১টা লোক মুক্তি পেয়ে গেল।'