গত ১৮ ফেব্রুয়ারি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে ২৫ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ষষ্ঠ সমাবর্তন। অর্থাৎ বাংলাদেশের দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একই মাসে কাছাকাছি সময়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বয়সের বিচারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যৌবন পেরিয়ে পূর্ণবয়স্ক; যার বয়স বাংলাদেশের সমান। অন্যদিকে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বয়সের দিক থেকে একেবারে নবীন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দুটির তথ্য থেকে দেখা যায়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ বছরে চারবার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের সমান বয়সী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫২ বছরে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে ছয়বার। অন্যদিকে শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০২২ সালে ৫৩তম সমাবর্তনের আয়োজন করে। অর্থাৎ বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিতভাবে একটা লম্বা বিরতিতে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। অথচ প্রতি বছরই ছাত্র ভর্তি করার সময় তাঁদের শিক্ষাজীবন শেষে সনদ প্রদানের আনুষ্ঠানিকতার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত ছিল।
অনেকে যুক্তি দিয়ে থাকেন, সমাবর্তন আয়োজন একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। চার-পাঁচ বছরের দীর্ঘ বিরতিতে সমাবর্তন আয়োজন ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া বৈকি। এই ব্যয়ের একটি বড় অংশ বরাদ্দ করা হয় ১০-১৫ হাজার গ্র্যাজুয়েটের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন প্যান্ডেল তৈরি করতে। পত্রপত্রিকা মাধ্যমে জানতে পারলাম- এ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ষষ্ঠ সমাবর্তনের প্যান্ডেল বাবদ খরচ হয়েছে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। করোনা-পরবর্তী এই প্রচ্ছন্ন দুর্ভিক্ষের সময়ে এটি এক অবশ্যম্ভাবী বিলাসিতা বৈকি। বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্র্যাজুয়েট উভয়ের জন্যই এটি গলার কাঁটা। প্যান্ডেল ছাড়া সমাবর্তন আয়োজন সম্ভব নয়, আবার এত টাকার জোগান দেওয়াও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই অর্থ জোগানের চাপ গিয়ে পড়েছে রেজিস্ট্রেশন ফির ওপর। গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে বিরাজ করছে অসন্তোষ। ফেসবুকের টাইমলাইন ছেয়ে যাচ্ছে ক্ষেদভরা পোস্টে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুব সহজেই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। প্রতি বছর প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির সময় বিভাগের ছাত্র কল্যাণ তহবিল, বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত ফান্ডের মতো সমাবর্তন তথা শিক্ষাজীবন শেষে তাঁদের আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ প্রদানের বিষয়টি মাথায় রেখে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া উচিত। এটি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটে। অথবা শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন ফির মাধ্যমে এই আয়োজন করা যেতে পারে, যেমনটি এখন হচ্ছে। একইভাবে অনুষ্ঠান আয়োজন হতে পারে অডিটোরিয়াম বা কোনো কনভেনশন সেন্টারে। এতে প্রতি বছর অল্পসংখ্যক গ্র্যাজুয়েটের জন্য আয়োজন করতে হবে বলে এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বেগ পেতে হবে না। অন্যদিকে একটা বড় অঙ্কের অর্থের অপচয় রোধ সম্ভব হবে।
সমাবর্তন গ্র্যাজুয়েটদের জন্য শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে প্রবেশের এক মাইলফলক। তাই সমাবর্তন বক্তা হিসেবে গ্র্যাজুয়েটদের সামনে এমন একজন ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যাঁর জীবন থেকে গ্র্যাজুয়েটরা একটি সুন্দর ও বাস্তবধর্মী দিকনির্দেশনা পাবেন। সমাবর্তন বক্তা হতে পারেন শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা কিংবা প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সফল এবং বিশেষ অবদান রেখেছেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে একবার সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন টেকনোলজি জগতের অন্যতম পুরোধা অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস। যিনি বক্তব্যে তাঁর জীবনের তিনটি ঘটনা বর্ণনা করে গ্র্যাজুয়েটদের ভবিষ্যতে কী করণীয়, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। যা বিশ্বের কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগ। তাই একজন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ করা যেতে পারে, বিশেষ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া যেতে পারে। এতে সদ্য শিক্ষাজীবন সমাপ্তকারী গ্র্যাজুয়েটরা এ ধরনের সম্মানসূচক ডিগ্রি অর্জনের জন্য অনুপ্রাণিত হবেন। কর্মজীবনে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন। সমাজ ও মানবতার কল্যাণে ভূমিকা রাখবেন। মোট কথা, প্রতিটি সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দায়িত্ব হলো, গ্র্যাজুয়েটদের সামনে কর্মক্ষেত্রে সফলতা অর্জনকারী একজন আইডলকে তুলে ধরা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও জাতীয়তার গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি কিংবা সমাবর্তন বক্তা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নিজেদের প্রচলিত কনভেনশনের বাইরে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ফলে অনেক সময় সমাবর্তন বক্তব্য গ্র্যাজুয়েটদের জন্য মূল আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারে না।