ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। অর্থনীতিবিদ ও ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেওয়ার পর বর্তমানে ঢাকার ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাংলা ভাষায় তাঁর প্রথম বই উন্নয়নশীল দেশের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র: একটি রূপরেখা। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বইটি লিখিত হলেও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা কমবেশি বিধৃত হয়েছে। বইটির সূত্র ধরেই প্রথম আলো এই অর্থনীতিবিদের মুখোমুখি হয়।
প্রথমেই প্রশ্ন করতে চাই, আপনি বইয়ের শিরোনামকে অনুচিত সাহসী বলেছেন কেন? আমরা তো মনে করি, বইয়ে উচিত কথাই বলা হয়েছে।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: কারণটা হলো, সমাজতন্ত্র নিয়ে কিছু বলতে গেলেই নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও চীনের অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর এখন সমাজতন্ত্রের কোনো নির্দিষ্ট বা আদর্শগত সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, ভারত ও নেপালের শাসনতন্ত্রে বিভিন্ন সময় সমাজতন্ত্র কথাটি যোগ করা হয়েছে। লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার অনেক দেশে, যেখানে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান, সেসব দেশের রাষ্ট্রের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্রের উল্লেখ আছে। প্রশ্ন হলো, গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি ও সমাজতন্ত্রের ধারণার সমন্বয় কী করে করা যায়।
তাহলে কী ধরনের সমাজতন্ত্রের কথা আমরা বলছি?
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: ১৯৫০-এর দশকে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ভারতসহ কিছু উন্নয়নশীল দেশকে সমাজতান্ত্রিক নীতির দিকে ঝুঁকতে দেখা যায়। এসব দেশের গৃহীত উন্নয়নকৌশল ছিল তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুকরণে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নের চেষ্টা। প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসন এ নীতির মূল লক্ষ্য হলেও পরবর্তী তিন থেকে চার দশকে এ লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগতি হয়েছে খুব ধীরগতিতে। এরপর আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাজারমুখী উদারীকরণ ও মুক্ত বাণিজ্যের উন্নয়নদর্শন এসে সবকিছু বদলে দেয়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কী হলো?
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: স্বাধীনতার পরপর আমরা সমাজতন্ত্রকে আদর্শগতভাবে বাহ্যত ভারতের চেয়েও শক্তভাবে গ্রহণ করেছিলাম, বিশেষত প্রস্তাবিত পরিকল্পিত উন্নয়ন ও শিল্পের সরকারি মালিকানার বিষয়ে। কিন্তু ১৯৭৫-এর সরকার পরিবর্তনের পর অর্থনৈতিক নীতির এ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। এর পর থেকে অদ্যাবধি সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি সমাজতন্ত্রের বিষয়ে আমরা বেশ চুপচাপ আছি।
তাহলে এখন আবার সমাজতন্ত্রের প্রসঙ্গ সামনে এল কীভাবে?
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। আর্থিক খাতের অস্থিতিশীলতা, প্রাচুর্যের পাশাপাশি চরম বৈষম্য ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ক্রমবর্ধমান আধিপত্য এ ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একে ক্ষোভ বা একধরনের অনিবার্যতার দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটেই উন্নয়নশীল বিশ্বের কোথাও কোথাও তথাকথিত ‘নব্য-উদারীকরণপরবর্তী সমাজতন্ত্র’ নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকায় ইকুয়েডর, বলিভিয়া, ব্রাজিলে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়েই নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সে দেশের তরুণদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই পুঁজিবাদের বিপরীতে সমাজতন্ত্রের প্রতি ইতিবাচক ধারণা পোষণ করে।