আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন বেশ আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী সম্মেলন শেষে নতুন কমিটিও ঘোষিত হয়েছে। যদিও নতুন কমিটিতে পুরানোদের একচেটিয়া আধিপত্য রয়েছে। আগামী নির্বাচন ও বিরোধী দলের সরকার পতনের আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দলীয়প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাদের ওপর নেতৃত্ব দেন, তা নিয়ে শুধু দলের মধ্যে নয়, দলের বাইরেও ব্যাপক আগ্রহ-কৌতূহল ছিল। আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে শেখ হাসিনার বিকল্প হিসেবে কারো নাম এখনো ভাবা হয় না। তিনি ১৯৮১ সালে এক বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন। গত ৪১ বছর ধরে তিনি দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। এটা একটা রেকর্ড। আর কোনো দেশে কোনো রাজনৈতিক দলে সভাপতি পদে আর কেউ এত দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন বলে জানা নেই। তাই এটা ধরেই নেওয়া হয়েছিল শেখ হাসিনাই আবারও আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে নির্বাচিত হবেন। নতুন কমিটি ঘোষণার আগে কাউন্সিলরদের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা তাকে বিদায় দিয়ে নতুন কাউকে সভাপতি নির্বাচিত করার আহ্বান জানালেও উপস্থিত কাউন্সিলরদের সমবেত না-না ধ্বনিতে তা নাকচ হয়েছে। শেখ হাসিনাই টানা দশমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভাপতি পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন।
দলের দ্বিতীয় প্রধান গুরুত্বপূর্ণ পদ সাধারণ সম্পাদক। ওবায়দুল কাদের গত দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব সামলে এসেছেন। এবার সম্মেলনের তারিখ ঘোষণার পর কেউ কেউ অনুমান করেছিলেন সাধারণ সম্পাদক পদে হয়তো পরিবর্তন আসতে পারে। দলের কমপক্ষে আরও দশজন নেতা এই পদের প্রত্যাশী এবং উপযুক্ত বলে ওবায়দুল কাদের নিজেই সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন। কিন্তু সম্মেলনের তারিখ ঘনিয়ে আসার পর এটা অনেকের কাছেই স্পষ্ট হয়েছিল যে, ওবায়দুল কাদেরই শেখ হাসিনার আস্থার শীর্ষে আছেন। তিনিই তৃতীয় মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হবেন। হয়েছেও তা-ই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে হ্যাট্রিক করার রেকর্ড এতদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরই ছিল। জিল্লুর রহমান চার মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলেও সেটা টানা ছিল না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আমলে দুই বার এবং পরে শেখ হাসিনার সময়ে দুইবার তিনি সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জিল্লুর রহমান আওয়ামী লীগের একজন বিশ্বস্ত ও নিবেদিতপ্রাণ নেতা ছিলেন। শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জিল্লুর রহমান আমৃত্য রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
আওয়ামী লীগের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পর দলের ও দলের বাইরে সবাই কী খুব উৎসাহী ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন? এই প্রশ্নের এক কথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ জবাব দেওয়া কঠিন। দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণার পর উপস্থিত কাউন্সিলর-ডেলিগেট-সমর্থকদের হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে, দলের এই দুই পদে শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরের নির্বাচন সবাই মেনে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। তার প্রতি দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের নিঃশর্ত সমর্থনের কথা কোনো গোপন বিষয় নয়। শেখ হাসিনা তার প্রধান সহযোগী হিসেবে কাকে বেছে নেবেন এটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। আওয়ামী লীগে যারা তার সঙ্গে কাজ করেন, তাদের সবার নাড়ি-নক্ষত্র তার জানা। সবার সবলতা ও দুর্বলতার দিকগুলোও তার নখদর্পণে। তিনি ভালো বোঝেন, কোন টিম নিয়ে খেললে তার পক্ষে বাংলাদের উত্তেজনাপূর্ণ রাজনীতির খেলার মাঠে প্রতিপক্ষদের ঘায়েল করা সম্ভব। ‘খেলা হবে’ বলে গত কিছুদিন ধরে রাজনীতির মাঠ জমিয়ে রাখা ওবায়দুল কাদেরকে শেখ হাসিনা তার প্রধান টিমমেট হিসেবে বেছে নিতে দ্বিধা করেননি। দল এবং দলের বাইরে ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে কতটা সংশয় আছে, সেটা সম্ভবত এ কারণেই শেখ হাসিনা বিবেচনা করেননি যে, শেষ পর্যন্ত সবকিছুই তাকেই সামাল দিতে হয়। তবে এটা ঠিক যে, পুরনো কমিটি প্রায় পুনর্বহাল হলেও আওয়ামী লীগের ২২তম সম্মেলনটি যেভাবে সুশৃঙ্খল ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে এটাই প্রামাণ হয় যে, টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবেও সক্ষম হয়ে উঠেছে। জাঁক-জকমের বাহুল্য বর্জন করেও যে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো একটি সম্মেলন করা যায়, এবার তার প্রমাণ রেখেছেন সম্মেলনের প্রস্তুতির দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা।