প্রতিটি দেশের পরিচয় কোথায় থাকে? থাকে ভূগোলে ও ইতিহাসে। ভূগোল বদলায়; ইতিহাস এগোয়। ইতিহাস না এগোলে দেশের পরিচয় বিপন্ন হয়; দেশ পিছিয়ে পড়ে, দশা হয় হারিয়ে যাওয়ার। আমাদের এই দেশের ভূগোলে কাটাছেঁড়া ঘটেছে, এর নামও বদলেছে। ইতিহাসও এগিয়েছে। এগিয়েছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। একটা সংগ্রাম অস্তিত্বের, সেখানে নিয়ামক ভূমিকা মানুষের শ্রমের। আরেকটা সংগ্রাম রাজনৈতিক, তার মূল কাজটা ইতিহাসকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার। বলা যায় মুক্তিসংগ্রামের।
আমাদের দেশের মুক্তিসংগ্রামের রণকৌশল ছিল দুটি- একটি সাংবিধানিক, অপরটি সশস্ত্র। দুটোই শক্তিশালী ছিল। যারা অংশ নিয়েছেন বিশ্বাসের দিকে তারা কেউ ছিলেন জাতীয়তাবাদী, অন্যরা সমাজতান্ত্রিক। সংগ্রাম দুপক্ষই করেছে; সমাজতন্ত্রীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে পারেনি; এলে ইতিহাস ভিন্ন রকমের হতো। আসতে না-পারার কারণটাও কিন্তু রয়েছে ইতিহাসের ভেতরেই। দেশ ছিল পরাধীন। প্রথম সমস্যাটা ছিল স্বাধীনতার। নিকটকালে আমাদের সংগ্রাম ছিল ব্রিটিশের অধীনতা থেকে মুক্তির, এবং তার পরপরই পাকিস্তানিদের হাত থেকে পার পাওয়ার। ওই সংগ্রামে জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন, সমাজতন্ত্রীরাও ছিলেন। স্বাধীনতা লাভের প্রশ্নটা প্রথমত জাতীয় প্রশ্ন হিসেবেই দৃশ্যমান ছিল। জাতীয়তাবাদী সংগ্রামীদের লক্ষ্য ছিল দখলদারদের হাত থেকে মুক্তির; সমাজতন্ত্রীরাও সে-মুক্তি চেয়েছেন, কিন্তু তারা সেখানেই থেমে থাকতে চাননি; তাদের চেষ্টা ছিল মুক্তিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার, সমাজে একটি বিপ্লব ঘটানোর। সমাজের অভ্যন্তরে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে বৈষম্য রয়েছে তার অবসান ঘটাবার। কি সমাজতান্ত্রিক, কি জাতীয়তাবাদী, উভয় ধারার নেতৃত্বই এসেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে, যেটাই ছিল স্বাভাবিক। মধ্যবিত্তের পক্ষে জাতীয়তবাদী হওয়া যতটা সহজ, সমাজতন্ত্রী হওয়াটা ততটা নয়। সেটাই আসলে মূল কারণ; যে জন্য স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রক্ষমতা জাতীয়তাবাদীদের হাতেই চলে গেছে। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীদের হাতে, বাংলাদেশের সময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের হাতে।
পাকিস্তানি আমলে সেনাছাউনিতে বাঙালিদের একটা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি চলেছিল। সেটা সফল হয়নি। পাকিস্তানি গুপ্তচরদের তৎপরতা তো ছিলই, কিন্তু মূল দুর্ঘটনাটা ছিল বিশ্বাসঘাতকতার। সশস্ত্র গোপন তৎপরতা সর্বদাই ভীতিজনক; ভয় থাকে আবার প্রলোভনও থাকে। হয়তো ওই দুই কারণেই একজন ফাঁস করে দিয়েছিল ভেতরের খবর। বিদ্রোহীরা ধরা পড়েছেন। মামলা হয়েছে। সেটি বিখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, সেনাশাসকরাই নাম দিয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। আগরতলার সঙ্গে অল্প একটু সংশ্লিষ্টতা ছিল বটে; তবে মামলার ওই নামকরণের পেছনে অভিসন্ধিটা ছিল ভারতকে জড়ানো। অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীরা জানতেন যে সাফল্যের জন্য ভারতের সাহায্য দরকার পড়বে। ভারতের কাছ থেকে তারা অস্ত্র ও অর্থ প্রত্যাশা করেছেন। জরুরি ছিল স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের স্বীকৃতি এবং আকাশ ও জলপথে পাকিস্তানি সেনাদের চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি করা। মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে। মামলার সরকারি নাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য। শেখ মুজিবের সঙ্গে বিদ্রোহীদের যোগাযোগটা মিথ্যা ছিল না। বিদ্রোহীদের তিনি সমর্থন শুধু নয়, সহায়তাও দিয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পাশে থাকবার। তার সঙ্গে যোগাযোগের ফলেই আওয়ামী লীগের কয়েকজন সদস্য অভ্যুত্থান-পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, মামলায় যাদের অভিযুক্ত করা হয়।