গুজব বাঙালির জীবনে এক অপরিহার্য অঙ্গ। গুজবে সত্য-মিথ্যা থাকে, তার সঙ্গে থাকে বিনোদন। এই গুজব খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যখন দেশে কোনো সংকট চলে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের জনগণ দিনে-রাতে অসংখ্য গুজবে কান পাতত। এখন একান্ন বছর পরে এই গুজবের কেন্দ্রস্থল হয়েছে ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম ও ইউটিউব। মুখে মুখে ফেরা গুজব এখন এই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। গুজব কখনো কখনো অর্থবহ হয়ে ওঠে। বর্তমানে গুজবের বড় কারণ হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি, তার সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আকাশচুম্বীর ফলাফলে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে একটা অনিশ্চয়তা।
মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত যখন অর্থনীতির চাপে দিশেহারা তখনো কোটি টাকার গাড়ি বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন আমদানি করা গাড়ির শোরুমে। রিজার্ভের টাকা কমে আসছে, এলসি বন্ধ হয়ে গেছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এসব মিলিয়ে গুজব কখনো কখনো আংশিক সত্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ব্যাংকগুলোকে নিয়েও গুজবকারীরা তৎপর হয়ে উঠেছে। শোনা যাচ্ছে ব্যাংকে টাকা রাখা একেবারে নিরাপদ নয়, ব্যাংক আর টাকা দিতে পারবে না। কেউ কেউ ভয়ে ব্যাংক থেকে টাকাও তুলে নিচ্ছে। ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই অনাস্থার বিষয়টির একটি সহজ সমাধান হতে পারে, যদি অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এই আস্থাহীনতার বিষয়ে একটা সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করেন। তা না করে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি তারা যেসব বক্তব্য রাখছেন তাতে বিষয়গুলো আরও ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে খোদ যুক্তরাজ্যে একের পর এক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, চ্যান্সেলরের পদচ্যুতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসবটা মিলিয়ে মানুষের মনে আরও ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে। একদিকে বলা হচ্ছে এবার কৃষিতে ফলন বেড়েছে আবার অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দুর্ভিক্ষ আসছে।
আমাদের এই উপমহাদেশে দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ খাদ্যঘাটতি। সেই খাদ্যঘাটতি যদি না থাকে তাহলে দুর্ভিক্ষ কোথা থেকে আসবে? যদি কৃষিতে যথার্থ নজরদারি রাখা যায় তাহলে দুর্ভিক্ষ আসার তো কোনো সম্ভাবনা নেই। দেশে উৎপাদনশীল পুঁজিপতির চেয়ে আমদানিকারকদের সংখ্যা বেশি। আমদানিকারকরা দুর্ভিক্ষের প্রত্যাশা করে, খাদ্য আমদানির স্বপ্ন দেখে এবং এই স্বপ্নের টাকা পাচার করে টরন্টো, নিউ ইয়র্কের মতো জায়গায় বেগমপাড়া গড়ে তোলে। এর মধ্যেই আছে বিএনপির আন্দোলন এবং এই আন্দোলনের বিপরীতে সরকারও নিশ্চুপ নেই। বাধাবিপত্তি পেরিয়ে একের পর এক জনসভা করে যাচ্ছে তারা। যখন যেখানে জনসভা হচ্ছে সেই এলাকাটি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটা বড় ব্যাপার হচ্ছে সমঝোতা। কিন্তু অতীতে ও বর্তমানে কোথাও সমঝোতা দেখা যায় না। তাই বারবার আমাদের সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়ছে। যখন পরিস্থিতির কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া না যায় তখনই গুজব পল্লবিত হয়ে ওঠে। গুজবের বড় স্রষ্টা ফেইসবুক। ফেইসবুকে গুজব সৃষ্টি করে, নানা মিথ্যা অজুহাতে সংখ্যালঘুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, সাম্প্রদায়িক ইস্যু তোলা হয়। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য সম্পদ লুণ্ঠন চলতেই থাকে। এর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল কোনো না কোনোভাবে যুক্ত হয়ে যায়।