আমাদের সবার মনে থাকার কথা যে বাংলায় দুটি বিভীষিকাময় দুর্ভিক্ষ হানা দিয়েছিল—১৯৪৩ ও ১৯৭৪ সালে। দুটিই হয়েছিল মস্ত যুদ্ধের পটভূমিকায়। প্রথমটি উদ্ভূত হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আতঙ্কের মধ্য দিয়ে; আর দ্বিতীয়টি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ অনুসরণ করে এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফাঁদে। যা হোক, উভয় দুর্ভিক্ষের দুঃখজনিত বেদনার প্রতিচ্ছবি জাতির দুই প্রজন্মকে তাড়া করে।
ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিল, ক্ষুধার্ত মানুষের ধনীর দরজায় টোকা মেরে কদাচিৎ সাড়া পাওয়া; যুদ্ধের ময়দানে নয়, বরং আপাতদৃষ্টিতে শান্তিময় এবং নিষ্ক্রিয় জায়গায়, যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তার পাশে, খালি ধানি জমিতে কিংবা বাজারগুলোতে লাশ পড়ে থাকা ইত্যাদি। স্বভাবতই, এত দিন অতীতের প্রেতাত্মার ভয়ে তাড়িত হয়ে নীতিনির্ধারকরা সব সময় সরাসরি খাদ্য বিতরণ কিংবা শক্তভাবে খাদ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ এড়ানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, সফল হয়েছেন, যদিও নীরব দুর্ভিক্ষ অর্থাৎ পুষ্টিহীনতা কমবেশি বিদ্যমান।
২০০০ সালে আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফ্রি) কর্তৃক প্রকাশিত হওয়া একটি বইয়ের নাম ‘Out of the shadow of famine : evolving food markets and food policy in Bangladesh’. বইটির সম্পাদনায় ছিলেন রইসুদ্দিন আহমেদ, স্তিফেন হেগব্লেড ও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী (প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা)। বাংলাদেশ কিভাবে দুর্ভিক্ষের অপরিবর্তনীয় হুমকি থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য দেশের খাদ্য বাজার ও খাদ্য নীতিমালায় রূপান্তর ঘটাল, সেই বর্ণনা নিয়ে ৩০৭ পৃষ্ঠার বইটি রচিত হয়েছিল। মোটকথা, বিখ্যাত ওই বইটি বলতে চেয়েছে বাংলাদেশের ধানের প্রযুক্তি উদ্ভাবন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, উপকরণ বাজার বেসরকারীকরণ ও উদারীকরণ নীতিমালা ইত্যাদি মিলিতভাবে একটি দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাকে অনেক নিচে নামিয়ে এনেছে এবং বলা যায়, বাংলাদেশ এখন দুর্ভিক্ষের ছায়ার বাইরে।
১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা আবারও উঠেছিল কোনো কোনো মহল থেকে, কিন্তু তৎকালীন সরকারের যথোপযুক্ত হস্তক্ষেপে সেটি থেকে মুক্তি মিলেছিল এবং দুর্ভিক্ষ ছিল অনেক দূরে।