যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভে সম্প্রতি একটি প্রস্তাব উঠেছে। ডেমোক্র্যাট দলের রোহিত খান্না এবং রিপাবলিকান দলের স্টিভ শ্যাবট এ প্রস্তাব তোলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতি শীর্ষক ৮ পৃষ্ঠার প্রস্তাবে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দায়ে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার আহ্বানও জানানো হয়। মার্কিন কংগ্রেসে প্রস্তাবটির উত্থাপন অবশ্যই ইতিবাচক অগ্রগতি। কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। দেশটি বিশেষ করে সে সময় চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। সে জন্য ইয়াহিয়া খানকে যুক্তরাষ্ট্রের তখন দরকার ছিল।
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার কারণে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে যে গণহত্যা চলেছে, তা জানা সত্ত্বেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এখন সেখানে গণহত্যার স্বীকৃতির দাবি ওঠার মানে হলো, যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ তারা জানে, এর অস্বীকৃতি সম্ভব নয়। বিশেষ করে গত ১০-১৫ বছরে একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে যে ধরনের কাজ হয়েছে; যে ধরনের প্রমাণ সামনে এসেছে; একই সঙ্গে যেভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যা স্বীকৃতির দাবি জোরালো হচ্ছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ নীরব থাকতে পারে না। তা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখাতে চাইছে, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, গণহত্যা বিষয়ে তারা সোচ্চার।
এরই অংশ হিসেবে আমরা দেখেছি, গত মার্চ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো সহিংসতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা হিসেবে দাপ্তরিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যার স্বীকৃতির পেছনে অবশ্য রাজনীতিও রয়েছে। বিশেষ করে ইউক্রেনে রাশিয়া যে গণহত্যা চালাচ্ছে, সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের গণহত্যার বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। চূড়ান্ত রায় যদিও এখনও হয়নি এবং বিচারকরা আদালতে প্রমাণসাপেক্ষেই রায় দেবেন। তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি একটা বড় বিষয়।
একাত্তরে বাংলাদেশে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা বলতে পারবে না- আমরা জানি না। কারণ একদিকে গণহত্যার সে খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল; অন্যদিকে এখানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিও তাদের বিষয়টি জানিয়েছেন। একাত্তরে ঢাকায় মার্কিন কনস্যুলেটের প্রধান আর্চার কে ব্লাড ইসলামাবাদে মার্কিন দূতাবাস এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে 'সিলেকটিভ জেনোসাইড' শিরোনামে একটা তারবার্তা পাঠান। সেখানে ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল, সে খবর জানানো হয়। তবে সে গণহত্যা সংঘটনের পর ৫০ বছর হয়ে গেছে। এখন সুযোগ থাকলেও জো বাইডেন তাঁদের অবস্থান কতটা পরিবর্তন করবেন, তা একটা বিষয়। মার্কিন কংগ্রেসে যেহেতু বিষয়টির দাবি উঠেছে, এখন দেখার বিষয়, অন্য কংগ্রেসম্যানরা কী প্রতিক্রিয়া দেখান। যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিলে বহু দেশ বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি দেবে। জাতিসংঘেও বিষয়টি যাবে। তাদের স্বীকৃতির মাধ্যমে পাকিস্তানের ওপর যে চাপ বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।