পূর্ব ও পশ্চিমের দ্বন্দ্ব ও দূরত্বের সূত্রপাতটা ঘটেছে হঠাৎ করেই, অনেকটা যেন অপ্রত্যাশিতভাবেই। ভেতরে ভেতরে অবশ্য প্রস্তুতি চলছিল। সে প্রস্তুতির প্রধান উপাদান একদিকে জনগণের অসন্তোষ এবং বিপরীত দিকে সরকারের নিপীড়ন। ১৯৬৮-এর ফেব্রুয়ারিতে আইয়ুব খান অসুস্থ হয়ে পড়েন, গুজব রটেছিল যে তিনি আর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে নাও উঠতে পারেন। ওদিকে কুম্ভ যত শূন্য হয় তার আওয়াজ বাড়ার যে নিয়ম তারই স্বাভাবিক অনুসরণে আইয়ুব শাসনের গৌরব গাথা প্রচারে ঢাকঢোল বাজনার মোচ্ছব শুরু হয়ে গিয়েছিল। আইয়ুব ক্ষমতা জবরদখল করেছেন ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে, সেই ‘বিপ্লব’র দশক পূর্তি পালনের জন্য মহা হুলস্থুল পড়ে যায়। সংবাদপত্রে বেতারে টেলিভিশনে অনবরত উন্নয়নের জয়গান শোনা যাচ্ছে, সরকারি পয়সা খরচের ঢল নেমেছে। বাবুর তুলনায় পারিষদদের গলার স্বর উঁচু হয়েছে। ‘লৌহমানব’ ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খান সাহেবের ছবি সকাল-সন্ধ্যা-রাতে দেখতে দেখতে মানুষ ত্যক্তবিরক্ত হয়ে পড়েছে; নানা রকমের গুজব ও রসিকতা চালু হয়েছে। আইয়ুবের শাসনামলে উন্নতি যে হয়নি তা নয়, নানা ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটেছে। বিশেষভাবে রাস্তাঘাটে, দালান-কোঠায়, যোগাযোগ ব্যবস্থায়, যা লোকে দেখেছে। পরিসংখ্যান বলল, মাথাপিছু আয় বেড়েছে কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এসব বৃদ্ধির কোনো ফল পায়নি, কারণ যত হয়েছে উন্নতি, তত বেড়েছে বৈষম্য; যেমন আঞ্চলিক তেমনি ব্যক্তিগত। পাল্লা দিয়ে। উন্নয়নের দশক যখন উদযাপিত হচ্ছিল তখন তো পূর্ববঙ্গের কোথাও কোথাও দুর্ভিক্ষই চলছিল। ১৯৫৫-৬০ সালের পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনাধীন উন্নতিতে পূর্ব-পশ্চিমে বৈষম্য বেড়ে যায়, ১৯৬১-৬৫ পরিকল্পনায় সেটা কমানো হবে এমন প্রতিশ্রিুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা কার্যকর হয়নি।
ওদিকে জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। যুবকরা কাতর হয়ে পড়েছে কর্মসংস্থানের স্বল্পতায়। গ্রামাঞ্চলে বিডি মেম্বার, চেয়ারম্যান ও টাউটদের দৌরাত্ম্য দুঃসহ হয়ে উঠছিল। পুলিশ ও আমলাদের উৎপাত বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। বিশেষভাবে অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছে ছাত্ররা। শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে শিক্ষাকে ব্যয়বহুল এবং শিক্ষার সুযোগকে সংকুচিত করার সরকারি নীতি ছিল হতাশাজনক। বিশেষভাবে বিএ পাসের জন্য শিক্ষাসময় দুবছরের জায়গায় তিন বছর করাটা ছিল অপ্রত্যাশিত ও দুঃসহ এক আঘাত। তরুণ ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। তাদের অগ্রজরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছে, চুয়ান্নতে যুক্তফ্রন্টের জয়ের জন্য সভা-সমাবেশে যোগ দিয়েছে, প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করেছে, অথচ সামরিক শাসন এসে তাদের গৃহবন্দি করে অরাজনৈতিক প্রাণীতে পরিণত করার চেষ্টায় ছিল। ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে দেয় ১৯৬২ সালের শুরুতেই। বিশেষ ঘটনা হয়ে এসেছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারে। তিনি গ্রেপ্তার হলেন ৩০ জানুয়ারি রাতে। করাচিতে। প্রতিক্রিয়ায় ঢাকার ছাত্ররা তপ্ত হয়ে ওঠে, তারা এমনিতেই আন্দোলনের কথা ভাবছিল, সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারের ঘটনা উত্তাপকে বিস্ফোরণের দিকে এগিয়ে দিল। এতে আওয়ামীপন্থি ছাত্রলীগ এবং বামপন্থি বিভক্ত দুই ছাত্র ইউনিয়ন একসঙ্গে হয়। পেছনে কাজ করেছিল ছাত্রদের মাধ্যমে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন শুরু করার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মণি সিংহের একাধিক বৈঠকের উপনীত সিদ্ধান্ত।
১৯৬১ সালের ডিসেম্বরের দিকে আইয়ুব খানের কৌশলগুলো শেষ হয়ে আসছিল। প্রথমেই তিনি দুর্নীতি দমন করবেন বলে হইচই বাধিয়েছিলেন। তারপর উন্নয়ন শুরু করেন। তার ক্ষমতা গ্রহণের বৈধতাদানের প্রশ্ন ছিল। তিনি ঘোষণা দিলেন যে পাকিস্তানের জন্য পশ্চিমা ধরনের গণতন্ত্র কাজ দেবে না। তাই এখানে নতুন ধরনের গণতন্ত্র চালু করা চাই। ১৯৫৬ সালের সংবিধানের এক ইউনিট ও পূর্ব-পশ্চিম দুই অঞ্চলের ভেতর সংখ্যাসাম্য অটুট দেখে তিনি চালু করলেন নতুন এক ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থা। নাম দিলেন বুনিয়াদি গণতন্ত্র। এ ব্যবস্থায় জনগণ যে ভোট দিতে পারবে না তা নয়; তবে তারা ভোট দিয়ে বুনিয়াদি গণতন্ত্রীদের নির্বাচিত করবে, নির্বাচিতরা ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করবেন, এবং উচ্চতর পর্যায়ে যতগুলো পরিষদ থাকবে, প্রাদেশিক ও জাতীয়, সবগুলোর জন্য নির্বাচকম-লী হিসেবে কাজ করবে। রাষ্ট্রব্যবস্থা হবে প্রেসিন্ডেন্সিয়াল, এবং প্রেসিডেন্টও এদের ভোটেই নির্বাচিত হবেন। বুনিয়াদি গণতন্ত্রীদের সংখ্যা হবে ৮০ হাজার; পূর্ব-পশ্চিমে সমান-সমান ভাগ, ৪০ হাজার ৪০ হাজার। ব্রিটিশ আমলে ইউনিয়ন বোর্ড ছিল, সে জায়গায় ইউনিয়ন পরিষদ বসানো হলো, অনেক বেশি ক্ষমতা দিয়ে। বুনিয়াদি গণতন্ত্রীরাই হলো শাসনব্যবস্থার মূল বুনিয়াদ। সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের নির্বাচন ক্ষমতা এদের হাতে থাকল। জনগণের কাছে নির্বাচিতদের কারোরই কোনো জবাবদিহি রইল না। ইউনিয়ন পরিষদকে রাজস্ব আদায় ও ব্যয় করার ক্ষমতাও দেওয়া হলো।