এই তো কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক থিসিস চুরির অভিযোগে পদাবনতি পেলেন। তিনি তাঁর থিসিসের প্রায় পুরোটাই ঝেড়ে দিয়েছেন অন্যের লেখা থেকে। প্রমাণিত এই সত্য এতটাই ভয়াবহ যে পুরো শিক্ষক সমাজকেই তা লজ্জার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমাদের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড এখন যে ধীরে ধীরে পড়াশোনা ছাড়া আর সব ব্যাপারেই বিখ্যাত হয়ে উঠছে, সেটাও তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রকাশিত খবর থেকেই টের পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের থিসিস চুরির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বেশ কয়েকবার এ রকম অভিযোগ উঠেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, অভিযোগ সত্য। এ রকম এক বিপন্ন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষকেরা।
আমি কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে তাঁদের লিখতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু পত্রিকায় সরাসরি এ বিষয়ে লেখার ব্যাপারে হয়তো সেলফ-সেন্সরশিপ কাজ করে। কিংবা এমনও হতে পারে, কাক কাকের মাংস খায় না। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হয়তো ভয়। কোথায় কী কথা বলতে গিয়ে সামাজিকভাবে হেয় হতে হবে, ক্ষমতা বা পেশিশক্তির খপ্পরে পড়ে মান-সম্মান যাবে—সেটাও হয়তো ভেবেছেন তাঁরা। কে আর সেই ঝুঁকি নিতে চাইবে? শিক্ষকদের এই নীরবতার একটা সামাজিক কারণ আছে। সমাজ সত্যকে কতটা মূল্য দিচ্ছে, সেটাই মূল আলোচনার বিষয় হতে পারে।
দুই
আমরা এখনই বলতে শুরু করতে পারি, এই শিক্ষকের জন্য শাস্তিটা কম হয়ে গেছে। আরও বড় শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল তাঁর। যিনি ওপরে ওঠার সিঁড়ির খোঁজ করতে গিয়ে বেছে নেন অন্ধকার শর্টকাট রাস্তা, তিনি তো শিক্ষক হওয়ারই উপযুক্ত নন। শিক্ষার্থীরা তাঁদের চোখের সামনে একজন ‘চোর’কে দেখতে পাবে। তাঁর প্রতি কি সত্যিই সম্মান রাখতে পারবে তারা? একজন ছিঁচকে চোরের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য কোথায়? শিক্ষা নিয়ে চুরির ঘটনা তো বুঝিয়ে দেয়, সমাজের জন্য ছিঁচকে চোরের চেয়ে এই চোর অনেক বেশি অপকারী।
এ কথাগুলো বলার সময় আমরা একটা দিকে খেয়াল রাখি না। আমরা যে ছবিটি হতাশ চোখে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে দেখছি, সে ছবিটি কিন্তু এককভাবে শিক্ষকদের ছবি নয়। দৃষ্টি একটু প্রসারিত করলে দেখা যাবে, সমাজের সর্বত্রই এই ধস নেমেছে। আমাদের মূল্যবোধ, চেতনা, নৈতিকতাসহ গর্ব করার মতো বিষয়গুলো থেকে ক্রমেই আমরা সরে যাচ্ছি। যে সেক্টরের দিকেই চোখ দিই না কেন, দেখতে পাব ভাটার টানে সব ভেসে যাচ্ছে সাগরে। পাড়ে পড়ে থাকছে শুধুই আবর্জনা। তাই সাংবাদিক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, চিকিৎসক, ব্যাংকার, উদ্যোক্তা, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনীতিবিদ, সরকারি চাকরিজীবী—তালিকা বাড়ানো যাবে যেমন ইচ্ছে, সবাই সেই ধস ‘উপভোগ’ করছেন। কখনো কখনো একেকটি সেক্টরে পচা দুর্গন্ধময় সংবাদের জন্ম হলেই আমরা কেবল বুঝতে পারি, সর্বনাশের শিকড়টা কত গভীরে পোঁতা আছে।