মাঠ কি আছে? কেমন আছে? মাঠগুলো থাকবে তো? আমার মতো অনেকের মনেই হয়তো এই ধরনের একটা আশঙ্কা কাজ করছে। আশঙ্কাটা নিতান্তই অমূলক নয়। মাঠ আছে। কিন্তু সারাদেশে মাঠের মোট সংখ্যা কত? কেউ কি বলতে পারবেন? জানা মতে, এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কতগুলো মাঠ আছে– শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ জাতীয় কোনো জরিপ করা হয়েছে বলেও আমার অন্তত জানা নেই। স্থানীয় প্রশাসন এ সম্পর্কিত তথ্য রাখলেও তা কতটা হালনাগাদ তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক পত্রিকাসমূহে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে এটা সুস্পষ্ট যে, মাঠের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই কমে যাওয়াটা কি ঠেকানো জরুরী?
আবার মাঠের প্রকৃতিগত পরিবর্তনও ঘটানো হচ্ছে যেমন, মাঠে মেলা আয়োজন করার জন্য পাকা স্থাপনা, টাওয়ার ও ঘর নির্মাণ করা, মাঠে জলাশয় খনন করা কিংবা মাঠের মধ্যে বনায়ন করা ইত্যাদি। সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনাসমূহ নিশ্চয়ই প্রত্যেকেই আমরা জাতীয় গণমাধ্যমে লক্ষ্য করেছি। এগুলো প্রয়োজনীয় উদ্যোগ মনে হলেও এর বিপরীতে যা হচ্ছে সেটা কি পরিমাণ ক্ষতির মুখোমুখি আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে– তা কি ভেবে দেখছি আমরা?
আইন থাকার পরও নদীগুলোর অবস্থা এবং প্রাণীদের হত্যা ও বিপন্নতা দেখে অনেকসময় মনে হয়– তারা যেন অসহায়ের মতো মানুষের অত্যাচার শুধু সহ্যই করে যায়। কিন্তু মাঠের ক্ষেত্রটা অবশ্য একটু ব্যতিক্রম, কারণ মাঠের মালিক আছে, অর্থাৎ নির্দিষ্ট মাঠের জায়গার নির্দিষ্ট মালিকানা কিংবা কর্তৃপক্ষ থাকাটাই স্বাভাবিক। সেই মালিক কিংবা কর্তৃপক্ষ ওইসব মাঠের ব্যবহার ও ভবিষ্যতের ব্যাপারে কী ধারণা পোষণ করেন? আমরা কি কখনো সেগুলো জানার চেষ্টা করেছি? তাই এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তৃত গবেষণার প্রয়োজন আছে এবং তা খুবই জরুরী বলেই আমার কাছে মনে হয়।
সম্প্রতি ঢাকার বাইরের একজন প্রবীণ শিক্ষক কথা প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে মোবাইলকে বেছে নিয়ে বলছিলেন, “আমরা তরুণ প্রজন্মের হাতে অনেকটা অস্ত্রের মতো মোবাইল তুলে দিয়েছি, কিন্তু এই অস্ত্রের উপযুক্ত ব্যবহার তো আমরা তাদেরকে শেখাইনি।” কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের সামনে প্রযুক্তির এখন অবাধ ও অবারিত মাঠ। সেই মাঠে কি তারা শুধু খেলবে? কি খেলবে? কতটুকু সময় সেখানে তারা খেলাধুলা করবে? নাকি পাশাপাশি বাস্তবের মাঠগুলোতেও তাদের খেলাধুলা করার প্রয়োজন আছে? শিশুরা তাদের বেড়ে ওঠার সময়কালে শুধুই কি ঘরোয়া গেমস আর নানান অনুষঙ্গে বিচরণ করবে, নাকি তাদের মুক্ত বাতাসে খেলাধুলা করার ও দেশিয় খেলায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠারও প্রয়োজন আছে?
আমাদের দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। দেশের সর্বশেষ জনশুমারি ও গৃহগণনা বলছে, দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম। অন্যদিকে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। জাতিসংঘের জনসংখ্যা উন্নয়ন তহবিলের প্রাক্কলন বলছে, ২০২৫–২৬ সালে প্রবীণের সংখ্যা হবে ২ কোটি। ২০৫০ সালে ওই সংখ্যা হবে সাড়ে ৪ কোটি, যা তখনকার জনসংখ্যার ২১ শতাংশ হবে। ফলে এই বয়স্ক মানুষদের মানসিক ও স্বাস্থ্যগত ভাবনা থেকে তাদের জন্য আলাদাভাবে হাঁটা-চলার জায়গা আদৌ কি রাখার প্রয়োজন আছে? এরকম অজস্র প্রশ্ন আমার মতো আশা করি অনেকের মনেই ঘোরাফেরা করে, কিন্তু মালিক কিংবা কর্তৃপক্ষের মনেও কি এ ধরনের প্রশ্ন আদৌ জন্ম নেয়?
যদি এ ধরনের প্রশ্ন জন্ম নিত, আর এ বিষয়ে সচেতনতা কিংবা ভবিষ্যত ও পরিবেশ আঙ্গিক বিবেচনায় কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা যদি থাকত তাহলে হয়ত সাম্প্রতিক সময়ে মাঠ নিয়ে বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত ঘটনা আমাদেরকে দেখতে কিংবা শুনতে হতো না। যে মাঠে খেলাধুলা বন্ধ রেখে মেলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়, মেলার সময়ও মাসব্যাপী খেলাধুলা বন্ধ থাকে, যে মাঠে পাকা স্থাপনা করা হয় মেলা শেষ হলে সেই মাঠ কি আবার সহজেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া যেতে পারে? প্রস্তুতির সময় থেকে শুরু করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে যতটুকু সময় লাগে তাতে কি পরিমাণ কিশোর ও তরুণদের আচার-আচরণ পাল্টে যাচ্ছে, তারা সেই সময়ে খেলাধুলার পরিবর্তে কোন কাজে সময় ব্যয় করছে– সেটা কি আদৌ আমরা খুঁজে দেখেছি? তরুণ সমাজের আজকের মাদকাসক্তি ও নানা ধরনের অবক্ষয়ের কারণ যদি প্রকৃত পক্ষে উন্মোচন করতে হয়, তাহলে আমি বলব মাঠকে স্বাভাবিক রাখার পরিবর্তে ভিন্ন কাজে লাগানোটাও অন্যতম একটা কারণ। ফলে এদিকটাতে আমাদের সবারই গুরুত্ব দেওয়ার সময় এখন এসেছে।