এ মাসের প্রায় পুরো সময় ধরে চলছে চা-শ্রমিকদের প্রতিবাদ-ধর্মঘট। একজন চা-শ্রমিক দৈনিক গড়ে মজুরি পান ১২০ টাকা। তারা তাদের জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে এ মজুরির পরিমাণ ৩০০ করার দাবিতে পথে নেমেছেন। মালিকপক্ষ সাত দিন অতিবাহিত হওয়ার পর মজুরি মাত্র ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সংগত কারণেই চা-শ্রমিকরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেননি। কারণ অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন আমাদের চা-শ্রমিকরা ও তাদের পরিবারগুলো।
অন্য যে কোনো পণ্যের মতোই চা আমাদের একটি অতিপরিচিত পণ্য। আমাদের গ্রামে-গঞ্জে, আনাচে-কানাচে চা-স্টলের উপস্থিতি রয়েছে। কোনো কোনো তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ছোট ছোট চা দোকানের সংখ্যা ৪ লাখের কম নয়। তবে পানীয় চা বিক্রি হয় ক্ষুদ্র দোকান থেকে শুরু করে পাঁচতারা হোটেল পর্যন্ত এবং এক কাপ পানীয় চায়ের দাম ৫ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এ রকম একটি জনপ্রিয়, বহুলসমাদৃত পণ্যটির উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আমাদের কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। কেননা, চা-বাগান ও তার প্রাণ চা-শ্রমিকদের অবস্থান আমাদের সমতলের বাইরে। একটি সমাজবিচ্ছিন্ন স্থানে চায়ের উৎপাদনের কাজটি সম্পন্ন হয়ে থাকে এবং সেখানে নিয়োজিত শ্রমিকরা আমাদের সমতলের সমাজ থেকে পৃথক জীবনযাপন করে। এমনকি তাদের সংস্কৃতি ও ভাষাও স্থানীয়দের সঙ্গে একাট্টা নয়। ফলে তাদের নিত্যদিনের দুঃখ, কষ্ট, কান্নার শব্দ আমরা শুনতে পাই না। কষ্টের মাত্রা যখন সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায়, তখন প্রতিবাদে তারা কদাচিৎ রাজপথে নেমে আসে; মিডিয়ায় জানান দেয়; আমরা কিছুটা সম্বিত ফিরে পাই। আজকে চা-শ্রমিকদের যে আন্দোলন, তা ওই ‘কদাচিতে’র একটি। আমরা এ আন্দোলনের সঙ্গে আন্তরিকভাবে সংহতি প্রকাশ করছি।
বাংলাদেশে চা উৎপাদনের কাজটি শুরু করে ব্রিটিশরা। প্রাথমিকভাবে ব্রিটেনে রপ্তানি করাই উদ্দেশ্য ছিল। কেননা, ১৮৩০ সালের তথ্যমতে, সেসময়ে ব্রিটিশরা গড়ে বছরে ৪ কোটি পাউন্ড বা ২ কোটিরও বেশি কেজি চা পান করত। এ চায়ের পুরোটাই আসত চীন থেকে। অ্যাংলো-ডাচ্ যুদ্ধের কারণে চীন ব্রিটেনে চা রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। স্বাভাবিক কারণেই ব্রিটিশরা চায়ের বিকল্প পথের সন্ধান করে এবং অবিভক্ত ভারতের বাংলাদেশ ও আসামের অঞ্চলকে চা উৎপাদনের উপযোগী হিসাবে বিবেচনা করে। ১৮৩৯ সালে বেশকিছু ব্রিটিশ পুঁজিপতি এবং ধনাঢ্য ভারতীয় ব্যবসায়ী যেমন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, বাবু মতিলাল শীল, হাজী হাশেম ইস্পাহানি এবং অন্যদের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় আসাম টি কোম্পানি। তাদের মূলধন ছিল ৩ লাখ পাউন্ড। এর বাইরে বাংলাদেশ অঞ্চলে তার বাস্তবায়ন ঘটে ১৮৪০ সালে। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে চায়ের চাষাবাদ শুরু হয় এ সালে। তখন বাগানের নাম ছিল ক্লুদের বাগান। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সে বাগান সফলতার মুখ দেখতে পায়নি। পরবর্তী সময়ে ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে চা-বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে সময়ে আমাদের সমাজে চা-পানের চল ছিল না। ব্রিটিশশাসিত ভারতের ইংরেজরা আর ভারতীয় কিছু উচ্চবিত্ত-অভিজাত শ্রেণির মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে সেসময়ে ভারতবর্ষে উৎপাদিত চায়ের প্রায় পুরোটাই ব্রিটেনে রপ্তানি করা হতো। কিন্তু বিগত প্রায় দেড়শ বছরে চা পানের চিত্র পালটে গেছে এবং তা ক্রমবর্ধমান হারে। এখন চা আর কোনো বিশেষ শ্রেণির পানীয় নয়, বরং ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবস্তরের আয়ের, সব বয়সের মানুষের কাছে একটি প্রিয় পানীয়। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১ কোটি ৮০ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হতো। এর মধ্যে ১ কোটি ৫০ লাখ কেজিই রপ্তানি হতো। মাত্র ২৪ বছরের মাথায় এসে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর চা উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ কোটি ১ লাখ কেজি। বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর গড়ে ৯ কোটি কেজিরও বেশি চা উৎপাদিত হয়। কিন্তু বেশিরভাগটাই অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে লাগে। চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে চা উৎপাদন রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এ বছর উৎপাদিত হয়েছে ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৬ হাজার কেজি চা। এর মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ রপ্তানি করা হয়েছে, যার পরিমাণ মাত্র ৩ লাখ ১৩ হাজার কেজি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ লাখ ৫০ হাজার কেজি রপ্তানি করা হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে; তারপর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান। সুতরাং রপ্তানির দিক বিবেচনায় না নিলেও অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের চা শিল্প অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জিডিপিতে চায়ের অংশীদারত্ব প্রায় ১ শতাংশ। তাই এ শিল্পের যে কোনো ধরনের অসংগতি আমাদের আলোচনায় উঠে আসতে বাধ্য।
চা বোর্ডের ২০২১ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে নিবন্ধিত চা-বাগানের সংখ্যা ১৬৭। যে সাতটি জেলায় বাগানগুলো অবস্থিত তা হলো-মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও। এ সাতটি জেলার ১৬৭টি বাগানে মোট ২ লাখ ৭৯ হাজার ৫০৭ একর জমিতে চায়ের চাষ করা হয়। সবচেয়ে বেশি চা-বাগান রয়েছে মৌলভীবাজারে। দেড় লাখ একরেরও বেশি জমিতে এ জেলায় চায়ের চাষাবাদ হয়। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে হবিগঞ্জ এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে শ্রমশোষণ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া; তবে শিল্পভেদে এর তারতম্য আছে। সম্ভবত চা শিল্পে শোষণের মাত্রা সর্বোচ্চ। চা বোর্ডের তথ্যমতে, বাংলাদেশের অতি ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরাই চা বাগানের মালিক এবং তারা বাংলাদেশে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বলে স্বীকৃত। আর যাদের দ্বারা তাদের এ প্রতিষ্ঠা, সেই শ্রমিকগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত। সামান্য সুযোগ পেলেই মালিকপক্ষ মায়াকান্না শুরু করে দেয়। শ্রমিকের ন্যায্য পাওনাকে অস্বীকার করে নানা ধরনের বাহানার খবর পত্রপত্রিকায় উঠে এসেছে। চা সংসদের দেওয়া তথ্য বলছে, চলমান ধর্মঘটের কারণে দেশের চা বাগানগুলোর গড়ে ১৫ কোটি টাকা করে ক্ষতি হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৮০ কোটি টাকারও বেশি চা নষ্ট হয়ে গেছে। অপরদিকে সংকট সমাধান হয়ে নতুন করে শুরু করা হলে অন্তত দেড় মাস চা উৎপাদন শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। প্রায় ১ সপ্তাহ ধরে চা প্লাকিং না হওয়াতে এসব পাতা কেটে ফেলে দিতে হবে। সব মিলে চলমান শ্রমিক অসন্তোষ চা খাতের ৫০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি করবে বলে মনে করছেন তারা। বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতিজনিত কারণে প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষতিও শ্রমিক অসন্তোষের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও মালিকপক্ষের লোকসানের কথাই মেনে নিলাম। কিন্তু শ্রমিকদের দাবি কী ছিল? দৈনিক মজুরি ১৮০ টাকা বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশে চা শ্রমিকের সংখ্যা ১ লাখ ২৫ হাজার। যদি ১৮০ টাকা বৃদ্ধি করা হতো, তাহলে মালিকপক্ষের অতিরিক্ত ব্যয় হতো দৈনিক ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। তাহলে এ সামান্য টাকার বিপরীতে ১৫ কোটি টাকার লোকসান কাঁধে নিলেন কেন? সুতরাং আক্রোশের বশবর্তী হয়ে একটি স্বচ্ছ হিসাব কষতেও ভুল করে ফেললেন। আপনাদের লোকসান যতই হোক, বিলাসবহুল জীবনে তো তা কোনো রকমের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে না!