নরসুন্দরপুরের চৌধুরীদের একসময় বেশ প্রতিপত্তি ছিল। জমি-জোতদারি তো ছিলই, ছিল লোক-লস্কর, পাইক-পেয়াদার বিশাল বহর। মহিষার মাঠে চাঁদের রাতে তাদের অশ্বারোহীর দল যখন পরের দিন পাশের জমিদার রামজীবনপুরের প্রাণনাথ বাবুর তালুকদারি দখলের লড়াইয়ে নামার মহড়া দিত তখন বোঝা যেত ক্ষমতা ও কুর্নিশের কৌলীন্য কীভাবে সময়ের স্রোতে বহমান। হোমনাথ ছিল অশ্বারোহী দলের দলপ্রধান এবং চৌধুরীদের প্রধান প্রতিরক্ষক। তার বিশাল বপু ও পেটানো শরীর মনে করিয়ে দিত শক্তিমত্তা যেন চিরস্থায়ী পত্তন নিয়েছে তার চোখে, চোয়ালে ও দুহাতের কবজিতে। মনে হতো সে যেন মর্ত্যলোকের অমর্ত্য অবয়বের প্রতীক। কিন্তু কালের কপোলতলে সম্রাট শাহজাহানের পত্নী প্রেমের পসার যেমন অমরতা পেয়েও পায়নি তেমনি হোমনাথকেও একদিন কঙ্কালসার হয়ে শ্মশান ঘাটার শবযাত্রায় শামিল হতে হয়েছিল।
বর্ম পরিহিত সশস্ত্র হোমনাথ অনেক দূর পর্যন্ত তার দুচোখ প্রসারিত করে শত্র“র নিশানা ঠাওর করতে পারত। কিন্তু সে তার জীবনের অনিবার্য পরিণতি নিয়ে দূরদৃষ্টি দূরে থাক-নিকট দৃষ্টিতেও ছিল না। তার মনের জোর তার চাহনিতে, সহিসের লাগাম টানায় কিংবা তরবারির চাকচিক্যের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠত। তার মনে হতো অমরাবতীর জলে তার মা জননী তাকে যেন সদ্য চুবিয়ে এনেছেন তার গোটা দেহ অমরার আশীর্বাদ পেয়েছে। হোমনাথের ধরাকে সরা জ্ঞানের কা-কারখানা দেখে একদিন তার মা ডেকে বলেন, ‘বাছা আশপাশে একটু তাকাস। কেউ কিন্তু একদিনের জন্যও এককভাবে চিরদিনের চরণতলে ঠাঁই পায়নি’। মা’র কথা হোমনাথের বড্ড বেশি মনে পড়ে সেদিন যেদিন নকীপুরের হরিচরণ বাবুর তীরন্দাজ বলরামের ছোড়া ছোট্ট একটা তীর তার বাঁ হাতের খালি জায়গাটাতে এসে বিঁধে। সেই তীরে বিষ মাখানো ছিল পচন ধরেছিল সে জায়গাতে, সারানো যায়নি হাজার বদ্দি-কবিরাজি করেও। হাতের কবজি সমেত কেটে ফেলেও শেষ রক্ষা হয়নি হোমনাথের। শোনা যায়, মধুমেহ রোগ বাসা বেঁধেছিল হোমনাথের শরীরে। শেষ বয়সে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়েছিল তাকে। নিজের দেহে বাসা বেঁধে থাকা নীরব ঘাতক এই রোগটি আগেভাগে শনাক্ত করার শক্তি ছিল না হোমনাথের।