সুশীল সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশ স্বঘোষিত ‘হিরো’ আলমের প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল। গণমাধ্যমও কম যায় না। তারা হিরো আলমের প্রতিদিনকার খবর প্রকাশ করার জন্য বেশ তৎপর। সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের এমন তৎপরতায় হিরো আলম প্রতিবেশী দেশের মানুষের কাছে বাংলাদেশের এক নম্বর ‘হিরো’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও নায়ক বা হিরো হিসেবে অভিনয় করার জন্য যে ধরনের যোগ্যতা থাকা দরকার একজন অভিনয় শিল্পীর, হিরো আলমের মধ্যে তার কোনও গুণই নেই। ডিবি পুলিশের মতো তার চেহারা-সুরত, বাচনভঙ্গি, রুচি এগুলো নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই। আমার বিবেচনার বিষয় তার অভিনয় দক্ষতা। হিরো আলমের শুধু হিরো চরিত্রে নয়, সাধারণ কোনও চরিত্রেও অভিনয় করার মতো কোনও যোগ্যতা নেই।
হিরো আলম নিজেও এই সত্য স্বীকার করেছেন। তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, তিনি অভিনয় জানেন না, তার গানের গলাও নেই। কিন্তু নিজের ভালো লাগার জন্য তিনি সিনেমা তৈরি করেন, গান গান। কেউ যদি তার ভালোলাগার জন্য বেসুর গলায় গান গায়, অভিনয় করেন তাহলে আমাদের সেখানে আপত্তি করার মতো কিছু নেই। কিন্তু যখন সংগীত শিল্প না হওয়া সত্ত্বেও শিল্পীর মতো গান গেয়ে মঞ্চ কাঁপাতে চান, অভিনয় শিল্পী না হওয়া সত্ত্বেও অভিনয় করে দর্শকের কাছে হিরো সাজতে চান, তখন আপত্তির বহু কারণ রয়েছে। ওই আপত্তি হিরো আলম গরিব ঘরের সন্তান, বেশি লেখাপড়া জানেন না অথবা তিনি প্রভাবশালী নন সেই কারণে নয়; বরং ওই আপত্তি শিল্পকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য করা। হিরো আলমের এখন পর্যন্ত যেসব অভিনয় ও গান প্রচারিত হয়েছে তার কোনোটি কি অভিনয়ের পর্যায়ে পড়ে? কোনও গান কি শিল্পের পর্যায়ে পড়ে? যদি না পড়ে তাহলে হিরো আলমকে নিয়ে এত মাতামাতি কেন?
বাংলাদেশের বহু অভিনয় শিল্পী, গায়ক হতদরিদ্র পরিবার বা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। তারা তাদের প্রতিভা দিয়ে সাধারণ মানুষের মন জয় করেছে। রিকশাচালক আকবর যখন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ মাতিয়ে দেশের মানুষের মন জয় করেন তখন কেউ আকবরের গান গাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আকবর গরিব বলে তার গান গাওয়া নিয়ে আপত্তি করেনি। অথবা এতিম বলে পরীমণির অভিনয় দক্ষতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। তাহলে হিরো আলমকে নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে কেন?
হিরো আলমকে সমর্থনকারী সুশীলদের বোঝা দরকার, হিরো আলমের মধ্যে কোনও অভিনয় প্রতিভা নেই, তার গলায় সুর নেই। এই না থাকা সত্ত্বেও তিনি যখন নিজেকে গায়ক বলে, নায়ক বলে পরিচয় দিচ্ছেন, নায়ক-গায়কের মতো মঞ্চ মাতাচ্ছেন, আপত্তিটা তখন উঠছে। তিনি যদি ঘরে বসে গান গাইতেন, বাথরুম সিঙ্গার হতেন, তখন তার গান গাওয়া নিয়ে আপত্তি উঠতো না।
হিরো আলমকে গান গাওয়া বারণ করায়, অভিনয় করতে নিষেধ করায় তিনি আপত্তি করছেন। বলছেন, এটা তার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। আসলে কি তাই?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার যুগে হিরো আলমের রুচিহীন ও বিকৃত সংস্কৃতির চর্চা অবাধে চলছে। একশ্রেণির রুচিহীন মানুষ সেগুলো নিয়মিত দেখছে বলেই হিরো আলম প্রান্তিক মানুষের হিরো এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। চলচ্চিত্র ও গান গাওয়ার নামে হিরো আলম যা করছেন তা প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা ছাড়া অন্য কিছু নয়। কারণ, ওগুলো শিল্প নয়। চলচ্চিত্র বা সংগীত নয়। কিন্তু প্রান্তিক মানুষ (যারা প্রধানত হিরো আলমের দর্শক ও শ্রোতা) যাদের কোনটা শিল্প আর কোনটা বিকৃতি এমন বিবেচনা করার বোধ নেই, তাদের হিরো আলম চলচ্চিত্র ও সংগীত বলে অখাদ্য খাওয়াচ্ছে বলেই তা প্রতারণার পর্যায়ে পড়ছে।
ভেজাল খাদ্য বিক্রির মতো ‘ভেজাল সংগীত’, অশ্লীল ও বিকৃত অভিনয় প্রচার করা অপরাধ। আর উপর্যুক্ত ভেজাল সংগীত ও অশ্লীল-বিকৃত অভিনয় প্রচারকে জায়েজ করতে হিরো আলম তার হিরো নামকে ব্যবহার করছে। সাধারণ মানুষ আলমের নামের আগে হিরো থাকায় ধরে নিচ্ছে হিরো আলম আসল হিরো। তাই হিরো আলমের নাম পরিবর্তন সবার আগে দরকার। বাংলাদেশে হিরো নামটি কেবল হিরো আলম ব্যবহার করছে তা নয়, বহু মানুষের নাম আছে হিরো। হিরো নাম রাখা যেকোনও মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু যখন অসৎ উদ্দেশ্যে হিরো নাম ব্যবহার করা হয় তখন অবশ্যই ওই বিষয় নিয়ে আপত্তি করার বহু কারণ আছে। এটা অনেকটা কোনও রকম ডাক্তারি বিদ্যা না থাকা সত্ত্বেও নামের আগে ডাক্তার লেখার মতো। যদি কেউ তার নামের আগে ডাক্তার যুক্ত করে তাতে আমাদের আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু আপত্তি তখন অবশ্যই উঠবে যখন কেউ কোনোরকম ডাক্তারি বিদ্যা ছাড়াই নামের আগে ডাক্তার লিখে চেম্বার দিয়ে রোগী দেখা শুরু করবে। হিরো আলমের নামের আগে হিরো লেখায় আপত্তি এখানে। তিনি উকিল মুন্সির মতো তার নামের আগে হিরো শব্দটি লেখেননি। বরং একটি অসৎ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তার নামের আগে হিরো শব্দটি বসিয়ে নিজেকে হিরো আলম বলে প্রচার করছেন। হিরো আলম পরিচয় দিয়ে তিনি অভিনয় জানা না সত্ত্বেও অভিনয় করছেন, গান গাইছেন এবং তা প্রচার করছেন।